বাঘ বিড়াল কোরবানি ও মেকানিজম

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে শহরে টহল দিচ্ছে বিজিবি। ছবিটি গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জ কলেজের সামনে থেকে তোলা l প্রথম আলো
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই গুজব ও গুঞ্জন ডালপালা মেলছে। চায়ের আড্ডা, দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে প্রার্থী ও প্রতীক নিয়ে নানা রকম আলোচনা জমে উঠেছে। অনেকেরই প্রশ্ন, কে জয়ী হবে—প্রতীক, না প্রার্থী। প্রতীক জয়ী হলে এক রকম ফল হবে। আর প্রার্থী জয়ী হলে আরেক রকম।
আমরা আপাতত জয়-পরাজয়ের বিষয়টি ভোটারদের জন্য রেখে সিটি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নজরকাড়া কয়েকটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এবারের নিরুত্তাপ নির্বাচনী প্রচারে কিছুটা রসের জোগান দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী। গয়েশ্বর বলেছেন, ‘নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে এবার বাঘের থাবা পড়বে না এবং বিড়ালের খামছিতে ভয় পাবেন না।’ তাঁর এই বক্তব্য শুনে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, তাহলে কি বিএনপি গেলবারের নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীকেই ‘বাঘ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে? যিনি বিএনপির চেয়ারপারসনকে কয়েক ঘণ্টা কাঁচপুর ব্রিজে আটকে রেখেছিলেন, তিনি হলেন তাদের কাছে বাঘ। আর সেই বাঘকে ধরাশায়ী করা বিজয়ী প্রার্থী বিড়াল? তা ছাড়া একজন প্রার্থীকে ইঙ্গিত করে খামছিতে ভয় না পাওয়ার কথা বলা কোনোভাবে শালীনতার পর্যায়ে পড়ে না। আর ওমর ফারুক চৌধুরী অতখানি না গেলেও মন্তব্য করেছেন, বিএনপি প্রতিবার নির্বাচন এলে একেকজনকে কোরবানি দেয়। গতবার ভোটের আগের রাতে তৈমুর আলম খন্দকারকে কোরবানি দিয়েছে। এবারে ভোটের দিন সকাল আটটায় সাখাওয়াত হোসেন খানকে কোরবানি দেবে। বিএনপির কোরবানি দেওয়ার খবরটি যুবলীগপ্রধান আগেভাগে কীভাবে জানলেন, সেই প্রশ্নও উঠেছে। তাহলে কি তাঁর যোগাযোগ ধানমন্ডি ৩ নম্বরের চেয়ে গুলশানের সঙ্গেই বেশি?

গত রোববার রাতে বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে দেখা। তিনি তড়িঘড়ি বাসায় চলে গেলেন এই অজুহাত দেখিয়ে যে পরদিন সকাল সাতটায় তাঁকে নারায়ণগঞ্জে যেতে হবে। কেননা, সোমবারই ‘বহিরাগত’ নেতাদের সেখানে যাওয়ার শেষ দিন। নির্বাচন কমিশন এক পরিপত্র জারি করে বলেছে, সোমবার মধ্যরাতের পর নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা নন—এমন কেউ সেখানে যেতে পারবেন না। এই পরিপত্র দেখে বিএনপির এক নেতা অভিযোগের সুরে বললেন, তাঁরা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মঙ্গলবার অর্থাৎ নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর যাওয়া রহিত করতেই এই পরিপত্র জারি করা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করি, কেন দলীয় প্রধানকে আগে আনলেন না? তিনি বললেন, শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় নিয়ে আসাই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে বিএনপির মিডিয়া সেলেই আলাপ হলো বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে। তাঁদের কেউ নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা, কেউ বা এসেছেন ঢাকা থেকে। কেবল বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগেরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী নির্বাচনী প্রচারে সেখানে গিয়েছেন। বিএনপির দাবি, বিভিন্ন পর্যায়ের ১০৩ জন কেন্দ্রীয় নেতা নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী প্রচারে যোগ দিয়েছেন। গতকালও মিডিয়া সেলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমদ ও মিজানুর রহমান মিনু সাংবাদিকদের ব্রিফ করছিলেন। আওয়ামী লীগের ‘বহিরাগত’ নেতার সংখ্যা এত বেশি হবে না। কারণ, মন্ত্রী-সাংসদদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। তারপরও অ-সাংসদ ও অ-মন্ত্রী নেতারা সেখানে গিয়েছেন। দুই দলেই একটি বিষয় লক্ষ করা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতারা গেলেই স্থানীয় নেতারা নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে নামেন। অন্যথায় তাঁদের কদাচিৎ দেখা যায়।
গতকাল বেলা ১১টায় শীতলক্ষ্যা নদীর ঘাটসংলগ্ন একটি সরকারি অফিসে সিটি নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে বেশ বিতর্ক হচ্ছিল। পদাধিকারীদের কেউ নৌকার পক্ষে, কেউ ধানের শীষের। যাঁরা নৌকার পক্ষে, তাঁরা বলছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দুর্বল বলেই সেলিনা হায়াৎ আইভী জিতে যাবেন। আর যাঁরা ধানের শীষের পক্ষে, তাঁরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দুর্বল মনে করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তো হিলারিকে হারিয়ে দিয়েছেন। সাখাওয়াতকেও দুর্বল ভাবার কারণ নেই। জবাবে বিপক্ষ দল বলছে, ট্রাম্প তো পপুলার ভোটে জেতেননি। এখানে পপুলার ভোটেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। দেখা যাক ২২ ডিসেম্বর কী হয়। তবে প্রার্থী-কর্মী-ভোটার যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা সবাই চান নির্বাচনটি সুষ্ঠু হোক।
যদিও তাঁদের কারও কারও মনে শঙ্কাও আছে। বিগত নির্বাচনে সব শক্তি ছিল দৃশ্যমান। এবারের নির্বাচনে অদৃশ্য শক্তিও কাজ করছে। তার প্রমাণ পেলাম গতকাল স্থানীয় অন্তত অর্ধডজন পত্রিকায় একই শিরোনাম দেখে, ‘নৌকায় ভরসা রাখতে পারছেন না আইভী’। কেউ হয়তো লজ্জার খাতিরে প্রশ্নবোধক বা আশ্চর্যজনক চিহ্ন জুড়ে দিয়েছেন। অন্যরা সরাসরি। মজার বিষয় হলো, প্রতিটি পত্রিকার রিপোর্টের ভাষা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অভিন্ন। এটাকেই নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিক বন্ধুরা অদৃশ্য শক্তির ‘মেকানিজম’ বলে মনে করছেন।

Comments