প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়ল কি?

দু’হাজার তেরোর দশ জানুয়ারি ছাব্বিশ হাজার একশ’ তিরানব্বইটি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ ভাগের পর থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ধারাবাহিক ইতিহাস নিম্নমুখী। সাতচল্লিশ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ঊনত্রিশ হাজার ছয়শ’ তেত্রিশটি। সত্তরে তা নেমে আসে ঊনত্রিশ হাজার ঊনত্রিশটিতে। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। সেখানে ঘাটতি থাকলে উচ্চ শিক্ষায় যত চাকচিক্য থাক শিক্ষা ব্যবস্থাটা ঠিক মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এখনও করুণ। বেসরকারী প্রাথমিকের অবস্থা তো ভয়াবহ। দীর্ঘদিন ধরে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন।
তিয়াত্তর সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে পুরোপুরি জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অতগুলো প্রতিষ্ঠান এক সঙ্গে সরকারী করা সম্ভব নয় বলে ধাপে ধাপে করার জন্য কয়েক বছর সময় নেয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় পাঁচ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল সে সময়ই। উনিশ শ’ চুয়াত্তর সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করা এবং উনিশ শ’ তিরাশি সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। তাদের প্রস্তাব ছিল, আট বছরের প্রাথমিক শিক্ষা হবে সার্বজনীয় বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল এ সরকারের মেয়াদে এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। তাদের মতে, এটা করতে হলে সরকারী-বেসরকারীসহ প্রায় আশি হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ এবং অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে হবে। দেশের দু’হাজার দু’শটি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল চরম দুরবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। এ সংক্রান্ত যেসব প্রস্তাব এসেছে তা বাস্তবায়ন করতে যে টাকা ও অবকাঠামো সুবিধা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতেই ছয় সাত বছর লাগবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির সম্ভাবনাও নাকি রয়েছে। কারণ ব্যবস্থাটা তখন দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।
তবে সরকারের প্রথম মেয়াদে সম্ভব না হলেও দ্বিতীয় মেয়াদে ঘোষণা এসেছিল দু’হাজার ষোল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। কিন্তু এ বছরও পঞ্চম শ্রেণীতেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণী পরীক্ষা হয়েছে। ঠিক কবে এ পরীক্ষা উঠে যাবে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। সুতরাং বাস্তবে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত।
যা হোক, আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তার এতো বছর পর দু’হাজার তেরোয় একসঙ্গে এতগুলো বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়। এতে বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক লাখ তিন হাজার আটশ’ পঁয়তাল্লিশ জন শিক্ষকের চাকরিও সরকারী হয়েছে। দু’দশকের বেশি সময় ধরে এই শিক্ষকরা আন্দোলন করছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয়করণের এ সিদ্ধান্ত তিন ধাপে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রথম ধাপে জানুয়ারি মাসের এক তারিখ থেকে বাইশ হাজার নয়শ’ একাশিটি রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়ের একানব্বই হাজার চব্বিশ জন শিক্ষক, দ্বিতীয় ধাপে জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে স্থায়ী অস্থায়ী নিবন্ধন পাওয়া কমিউনিটি এবং সরকারী অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দু’হাজার দুশো বায়ান্নটি বিদ্যালয়ের নয় হাজার পঁচিশ জন শিক্ষক, এবং তৃতীয় ধাপে দু’হাজার চৌদ্দ সালের এক জানুয়ারি থেকে শিক্ষাদানের অনুমতির সুপারিশ পাওয়া ও অনুমতির অপেক্ষায় থাকায় নয় শ’ ষাটটি বিদ্যালয়ের তিন হাজার সাত শ’ ছিয়ানব্বই জন শিক্ষকের এ সুবিধা পাওয়ার কথা। এ শিক্ষকরা এতদিন সরকারী শিক্ষকদের মূল বেতনের সমান বেতন পেতেন। সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা হিসেবে দুশো টাকা করে পেতেন। বছরে একটি উৎসব ভাতা পেতেন দু’ভাগে। পেনশন ছিল না। পাশাপাশি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মূল বেতন পাঁচ হাজার পাঁচ শ’ টাকার সঙ্গে এলাকাভেদে বাড়ি ভাড়া পেতেন মূলের শতকরা পঞ্চান্ন থেকে পঁয়ষট্টি ভাগ। চিকিৎসা ভাতা সাত শ’ টাকা। টিফিন ও যাতায়াত ভাতা পেতেন শ’ পঞ্চাশ টাকা এবং উৎসব ভাতা বছরে দুটো। এ ছাড়া চাকরি জীবনে তিনটি টাইম স্কেল ও প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট পর্যায়ক্রমে পাওয়ার কথা। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছিল, তিন ধাপে জাতীয়করণের খরচ হবে বছরে ছয় শ’ একান্ন কোটি টাকা।
সব বিদ্যালয় জাতীয়করণ না হলেও দু’হাজার পনের সালে ঘোষিত পে-স্কেল অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। যে দুরবস্থার মধ্যে তারা ছিলেন তা অনেকটাই কেটে গেছে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য গতি আসেনি।
শিক্ষকদের বেতন বাড়লেও তাদের গুণগতমানের প্রশ্ন তো আছেই, প্রশ্ন আছে শিক্ষার্থীদের মান নিয়েও। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মূলত গরীব পরিবারের সন্তানরা। এদের মধ্যে কেউ কেউ মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চতর স্তরে পৌঁছানো এদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছতেই ঝরে যায় অনেকে। সামান্য সচ্ছল অভিভাবকও সন্তান নিয়ে কিন্ডারগার্টেন বা ওই মানের অন্য স্কুলে ছোটেন। তারা সন্তানের প্রতিদিনের পড়াশোনা তদারকির বিষয়ে প্রখর সচেতন। শিক্ষকদের যে কোন গাফিলতিতে তারা বিদ্যালয়ে গিয়ে জবাবদিহি চাইতে পারেন। শিক্ষকরাও পাঠদান বিষয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি সচেতন। সন্তানকে উচ্চশিক্ষার শিখর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েই অভিভাবকরা তার শিক্ষার ভিত নির্মাণের প্রতি মনোযোগী হন। কিন্তু অশিক্ষিত গরীব যে অভিভাবক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানকে পাঠান তার সচেতনতা ওই পাঠানো পর্যন্তই। তিনি জানেন না, সন্তান স্কুলে কি পড়ছে। ভুল শিখছে কিনা। শিক্ষককে ভুলের জন্য অভিভাবকের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো বিদ্যা বা অর্থের জোর তার নেই। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা যেসব বিদ্যালয়ে পড়ে সেখানকার শিক্ষকরা অভিভাবকদের চাপে, চৌকস শিক্ষার্থী পাওয়ার আনন্দে বা নিজের আর্থিক জীবনের স্থিতিশীলতার জন্য নিজের পেশার বিষয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সিরিয়াস। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামনে এর একটিরও উপস্থিতি নেই। নিজের গুরুত্বপূর্ণ পেশাটি তাই নিজের কাছেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। গ্রামাঞ্চলের বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের বেলায় এ কথা আরও বেশি সত্য। রাষ্ট্রের আয়ত্তে আসা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সচল রাখতে হলে এ বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে। সাধারণ শিক্ষিত স্বল্প বিত্ত মানুষ ও এখন শহরমুখী। আধুনিক জীপন যাপনের ছোঁয়া বিশষ করে সন্তানের সুশিক্ষার জন্য তারা উর্ধশ্বাসে ছুটছেন শহরে। প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের সুফল পেতে হলে একে আধুনিক জীবন যাপনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। বিদ্যালয়ের মান বাড়ানোর পাশাপাশি এখানে যারা পড়ছে তাদের জীবন যাপনের মানও বাড়াতে হবে। নইলে প্রাথমিক বিদ্যালয় নিস্তরঙ্গই থেকে যাবে।

Comments