খবরের চেয়ে জীবন বড় ক্যামেরা ছুড়ে ফেলে শিশুর জীবন রক্ষা

ক্যামেরা ছুড়ে ফেলে শিশুর জীবন রক্ষা
বোমা হামলার ধ্বংসযজ্ঞের ছবি তুলতে গিয়ে সিরিয়ার সাংবাদিক হাবাক ক্যামেরা ছুড়ে ফেলে আত্মনিয়োগ করেন আহত শিশুদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টায়। ছবি : টুইটার
পৃথিবীর মানুষের কাছে আজও দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে একটি ছবি। দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গ এক শিশু হামাগুড়ি দিয়ে আছে। তার পেছনে ওত পেতে একটি শকুন। শিশুটি খাবার খুঁজছিল। শকুনটি খাবার হিসেবে শিশুটির পিছু নিয়েছিল। ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘের খাদ্যগুদামের কাছে এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান আলোকচিত্র সাংবাদিক কেভিন কার্টার। ছবিটি পেয়েছিল পুলিত্জার পুরস্কার। কিন্তু শিশুটি?
একটি শিশুর জীবন। একটি ছবির কৃতিত্ব। এ নিয়ে আত্মদহনে ভুগেছিলেন কেভিন কার্টার। মর্মছেঁড়া একটি সুইসাইড নোট লিখে চার মাস পর ৩৩ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। পৃথিবীজোড়া প্রশ্ন রয়েছে—সাংবাদিকদের পেশাদারি আগে, নাকি মানবিকতা? এটি কি কোনো চিরন্তন দ্বন্দ্ব? নাকি সবার ওপর মানবিকতা, তার ওপর নাই?
গত শনিবার ঘটল হৃদয় নাড়ানো আরেক ঘটনা। সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের পশ্চিমে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত রাশিদিন এলাকার একটি তল্লাশিচৌকিতে অপেক্ষা করছিল কয়েকটি বাসের বহর। দেশটির অবরুদ্ধ শহরগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল বাসিন্দাদের। এমন সময় বিস্ফোরকভর্তি একটি গাড়ি ঢুকে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ১২৬ জন প্রাণ হারায়, যার মধ্যে ৬৮টি শিশু ছিল।
ঘটনাস্থলে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন সিরিয়ার ফটো সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী আবদ আলকাদার হাবাক। বিস্ফোরণের নৃশংসতার দৃশ্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। তখন তাঁর চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হতাহত ব্যক্তি। আগুন আর চিত্কার। এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখে হাবাক তাঁর ক্যামেরা ফেলে ছুটে যান আহত ব্যক্তিদের সহায়তায়। ছয়-সাত বছরের একটি শিশুকে উদ্ধার করে অ্যাম্বুল্যান্সের দিকে ছোটেন হাবাক। পরিস্থিতি এমন—একজন ফটো সাংবাদিক আগে ছবি তুলবেন, নাকি দুর্গতকে সহায়তা করবেন? হাবাক বেছে নিলেন মানবিকতা।
হাবাক একটি শিশুকে উদ্ধার করে অ্যাম্বুল্যান্সে দিয়ে আবার ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন আরেক শিশুকে বাঁচাতে। কিন্তু এসে দেখেন শিশুটি ততক্ষণে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। তাকে বাঁচাতে না পেরে পাশেই কান্নায় ভেঙে পড়েন হাবাক।
সিরিয়ায় ওই দিনের ঘটনার দৃশ্য ছিল এমন—প্রথম যে শিশুর কাছে হাবাক এগিয়ে গেলেন, সে তখন প্রায় আধমরা। এরপর তিনি দৌড় দেন আরেকজনের কাছে। কেউ একজন চিত্কার করে তাঁকে বলছিল, দূরে থাকো...সেও মরে গেছে। কিন্তু হাবাক নিজে পরখ করে দেখতে চাইলেন। এগিয়ে গেলেন শিশুটির কাছে। শিশুটি কোনোমতে শ্বাস নিচ্ছে। প্রাণ আছে। দ্রুত তিনি শিশুটিকে কোলে তুলে অ্যাম্বুল্যান্সের উদ্দেশে ছোটেন। তখনো তাঁর হাতে ঝোলানো সচল ক্যামেরা এই ধ্বংসযজ্ঞ রেকর্ড করে চলেছে।
হাবাক সিএনএনকে বলেন, ‘শিশুটি আমার হাত ধরল। এরপর চোখ দুটি একটু ফাঁক করে তাকাল। ’ তিনি বলেন, ‘সেখানকার দৃশ্য ছিল নির্মম। বিশেষ করে শিশুদের চিত্কার। আমার সামনেই কয়েকজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। ’ এ পরিস্থিতিতে আমি ও আমার সহকর্মীরা আহত ব্যক্তিদের সাহায্যের সিদ্ধান্ত নিই। পরে আমরা আমাদের ক্যামেরা একপাশে রেখে আহত লোকজনকে উদ্ধার করতে লাগলাম। ’
হাবাকের উদ্ধার অভিযানের এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেন ঘটনাস্থলে থাকা আরেক আলোকচিত্রী মুহাম্মদ আলরাগিব। তিনি বলেন, ‘আমিও কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে সাহায্য করেছি। এরপর ছবি তুলতে শুরু করি। এ ঘটনার গ্রহণযোগ্যতার জন্য আমি সব কিছুর ছবি তুলতে চাইছিলাম। একজন তরুণ সাংবাদিক জীবন বাঁচাতে সহায়তা করায় আমি গর্বিত। ’
হাবাক বলেন, ‘আমি অ্যাম্বুল্যান্সে যে আহত শিশুটিকে নিয়ে গেছি, তার বয়স ছয় বা সাত বছর। তবে সে বেঁচে আছে কি না, তা আমি জানি না। ’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি তখন বেশ আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। আমি আর আমার সহকর্মীরা যা দেখেছি, তা অবর্ণনীয়। ’
দায়িত্বরত সাংবাদিকদের বা আলোকচিত্র সাংবাদিকদের কাছে খবর বা ছবির চেয়ে মানুষের জীবনের দাম বেশি হওয়ারই কথা। যদিও কখনো কখনো ব্যতিক্রমী ঘটনাও দেখা যায়।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর। সকাল সাড়ে ৯টা। বাংলাদেশের রাজধানী পুরান ঢাকায় দর্জি নিরীহ বিশ্বজিৎ দাস তাঁর কাজে যাচ্ছিলেন। এমন সময় বিনা কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। ওই দিন সকাল থেকে রাজধানীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছিল। পঁচিশ বছরের বিশ্বজিৎকে আন্দোলনবিরোধীরা নির্বিচারে কিল-ঘুষি-লাথি, রড দিয়ে পিটিয়ে ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ সময় বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। বরং সাংবাদিকরা সেই হত্যাকাণ্ডের ছবি তুলেছিলেন। সেদিন যদি ক্যামেরা ফেলে বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে এগিয়ে যেতেন সাংবাদিকরা, তাহলে বাংলাদেশেও আবদ আলকাদার হাবাকের মতো একজন আলোকচিত্র সাংবাদিকের দেখা মিলত। পেশাদারির চেয়ে মানবিকতা উত্কৃষ্ট পন্থা নয় কি?
mongsai79@gmail.com

Comments