আশুলিয়ায় কারখানায় আগুন, ২৬ নারী ও শিশু দগ্ধ

​রিজিয়ার মেয়ে লাভলী ও তাঁর ভা​ইয়ের মেয়ে ফাতেমা দুজন​ই দগ্ধ৷ ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ​ইউনিট থেকে গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো​রিজিয়ার মেয়ে লাভলী ও তাঁর ভা​ইয়ের মেয়ে ফাতেমা দুজন​ই দগ্ধ৷ ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ​ইউনিট থেকে গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো
ঢাকার আশুলিয়ার জিরাব এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে একটি গ্যাস লাইটার প্রস্তুতকারক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৬ জন শ্রমিক দগ্ধ হয়েছেন। তাঁরা সবাই নারী ও শিশু। তাঁদের বয়স ১৪ থেকে ৪০ বছর। দগ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজনের অবস্থা গুরুতর।
দগ্ধ নারী ও শিশুদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে এবং সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গ্যাস লাইটার প্রস্তুতকারক কারখানাটির নাম কালার ম্যাচ বিডি লিমিটেড। কারখানাটির আধা পাকা একতলা ভবনে গতকাল বিকেল চারটার দিকে হঠাৎ আগুন ধরে যায়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় সন্ধ্যা সাতটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু এর আগেই মালামাল, যন্ত্রসহ কারখানার প্রায় পুরোটাই পুড়ে যায়। এ সময় কারখানায় শতাধিক নারী ও শিশু কাজ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে দগ্ধ হন ২৬ জন। আহত হন আরও কয়েকজন।
দগ্ধ শিমু ও লাভলীকে হাসপাতালে নেওয়ার আগে তাঁরা আগুনের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, তাঁরা কাজ করছিলেন। হঠাৎ কারখানার ভেতরে আগুন দেখে তাঁরা দৌড়ে বের হয়ে আসেন। কিন্তু তারপরও আগুন থেকে বাঁচতে পারেননি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দায়িত্বরত চিকিৎসকেরা বলেছেন, সেখানে ২১ জন চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে নয়টি শিশু রয়েছে। তাদের শ্বাসনালিসহ শরীরের ১৬ থেকে ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। দগ্ধ এই শিশুরা হচ্ছে আঁখি (১৪), মুক্তি (১৪), খাদিজা (১৪), হালিমা (১৫), ফাতেমা (১৫), সোনিয়া (১৬), নাজমা (১৬), হাজিফা (১৬) ও লাভলি (১৭)।
বার্ন ইউনিটে ভর্তি ২১ জনের মধ্যে ২ জনকে আইসিইউ, ৪ জনকে হাইডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ), ৮ জনকে পোস্ট অপারেটিভ এবং ৭ জনকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পরিচালক আবুল কালাম বলেন, দগ্ধ ব্যক্তিদের সবাই নারী। প্রত্যেকেরই শ্বাসনালিসহ শরীরের ১২ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। শ্বাসনালি দগ্ধ হওয়ায় কেউই শঙ্কামুক্ত নন। তবে সাতজনের অবস্থা গুরুতর। গুরুতর আহত নারীদের মধ্যে মোছা. রকি (১৮) ও আঁখিকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। রকির শ্বাসনালিসহ শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অন্য শ্রমিকেরা হলেন জাকিয়া (১৯), জান্নাতি (২০), মাহিরা ওরফে নেহারা (৪০), মাহমুদা (২৬), রিনা (২০), আয়েশা (১৮), শিমু (৩৫), হেলেনা (২০), ফারজানা (১৮), সখিনা (২০) ও সনিয়া (২০)।
সাভারের আশুলিয়ার জিরাব এলাকায় গ্যাস লাইটার তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁদের স্বজনেরা। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলোদগ্ধ মাহিরার স্বামী বগুড়ার মোংলা মণ্ডল রাতে বার্ন ইউনিটে বসে ছিলেন। তিনি বলেন, ভিটেমাটি কিছুই নেই তাঁর। পেটের দায়ে তিন বছর থেকে ঢাকায় থাকেন। নিজে অন্যের বাসার আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করেন আর স্ত্রী কাজ করেন কারখানায়। মাসে যা আয় হয় তাতে কোনোমতে চলে সংসার। চিকিৎসক জানিয়েছেন, মাহিরার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
একই ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন মোংলা-মাহিরা দম্পতির একমাত্র ছেলের বউ। স্ত্রী ও ছেলের বউ দগ্ধ হওয়ায় মোংলা মণ্ডল মাঝেমধ্যেই নির্বাক হয়ে পড়ছিলেন।
রাত ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিটে রোগীদের দেখতে যান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনায় দগ্ধদের মধ্যে পাঁচজন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সেখানে অ্যাম্বুলেন্স রাখা আছে। প্রয়োজন হলে তাঁদেরও ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।
এনাম মেডিকেলে ভর্তি দগ্ধ পাঁচজনের নাম জানা যায়নি। তবে এনাম মেডিকেলের পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেছেন, তাঁদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পাঁচজনও নারী। তাঁদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাঁদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ডিইপিজেড) ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট প্রথমে ঘটনাস্থলে যায়। আগুনের তীব্রতা বেড়ে গেলে টঙ্গী, উত্তরা, সাভার ও ঢাকা থেকে আরও পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরে সমন্বিত চেষ্টায় সন্ধ্যা সাতটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ঘটনাস্থল থেকে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে কারখানা কর্তৃপক্ষের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, কারখানাটিতে প্রায় আড়াই শ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

Comments