সরকারদলীয় নেতাদের ‘পুনর্বাসনের’ স্থান

আপডেট: 
জেলা পরিষদের প্রশাসকের পদটিকে অনেকটা ‘পুনর্বাসন মঞ্চ’ হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের প্রার্থীদের বেশির ভাগই এমন সব প্রবীণ নেতা, যাঁরা দল বা সরকারে স্থান পাননি। এ ছাড়া দলীয় কোন্দলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের ‘মূল্যায়ন’ করা হয়েছে জেলা পরিষদে প্রার্থী করার মাধ্যমে।
২০১১ সালে দেশের ৬১টি জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। পাঁচ বছরের বেশি প্রশাসক দিয়ে চলার পর আগামী ২৮ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো পরোক্ষ ভোটে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গত শুক্রবার আওয়ামী লীগ দলের প্রার্থীদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে সর্বশেষ প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করা ১৭ জন বাদ পড়েছেন, বাকিরা মনোনয়ন পেলেন। দুর্নীতির অভিযোগ, বার্ধক্য ও দলীয় কোন্দলের কারণে ১৭ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানায়।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, জেলা পরিষদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। নিজস্ব উৎস ও সরকারের দেওয়া অর্থ মিলিয়ে বাজেটও বেশ বড়। ফলে একজন দক্ষ, সৎ ও যোগ্য মানুষ হলে জেলার অনেক উন্নয়ন সম্ভব। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে সরকারি দলই একমাত্র অংশগ্রহণকারী এবং তারাই বিজয়ী হবে। এ ক্ষেত্রে সাংসদ, জেলা প্রশাসন, উপজেলা চেয়ারম্যান—সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি না হলে তাঁরা কাজ করতে পারবেন না।
স্থানীয় সরকার বিভাগের ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জেলা পরিষদের অনুকূলে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গত পাঁচ বছরে ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরে জেলা পরিষদের জন্য বরাদ্দ আছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, মার্কেট, কৃষি ও অকৃষি জমি, খেয়াঘাটসহ বিভিন্ন খাতে নিজস্ব আয় রয়েছে। বাংলো, জমি, কোয়ার্টারসহ চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নিজস্ব জমি প্রায় ২২৫ একর। নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের রয়েছে প্রায় ২০০ একর জমি। রংপুর জেলা পরিষদের মালিকানায় প্রায় ৪০০ একর জমি রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন জেলা পরিষদের নিজস্ব আয়ে তাঁদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ চলে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচিত জেলা পরিষদ পাওয়া গেলে জেলায় জনহিতকর কাজের পরিমাণ বাড়বে। জেলা পরিষদের জনবলের বেতন-ভাতাসহ নিজস্ব খরচ স্থানীয় আয় থেকে মেটানো হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় জেলা বা খুলনা, বরিশাল বা রাজশাহীর মতো বিভাগীয় জেলাগুলোর আয় বেশ ভালো। অন্যান্য জেলায় আয় কম হলেও টেনেটুনে তারা চলতে পারে। তিনি বলেন, জেলার অবকাঠামো, সামাজিক ও শিক্ষার উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার এডিপি থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
এক প্রশ্নের জবাবে সচিব জানান, জেলা পরিষদে আগ্রহ নেই—এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। ৬১ জেলার ৭০০ জন নেতা আবেদন জমা দিয়েছেন। এটা কম নয়। বিরোধী দলগুলোর আগ্রহ না থাকার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সরাসরি নির্বাচন না হওয়ায় প্রতিটি দলের অবস্থান বেশ পরিষ্কার।
সরকারি দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর জামালপুরে বিক্ষোভ মিছিল, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। জামালপুর, শেরপুর, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিদ্রোহী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল দুজন নেতা বলেন, মনোনয়নপ্রাপ্ত নেতাদের অধিকাংশই নিজ জেলায় গুরুত্বপূর্ণ নেতা। কিন্তু তাঁরা রাজনীতি ও বয়সের দিক থেকে পড়তির দিকে। দল প্রায় আট বছর ধরে ক্ষমতায়। অনেক নেতা আছেন মন্ত্রী-সাংসদ হতে পারেননি। তাঁদের সেই সুযোগও নেই। তাঁরা আরও বলেন, দলীয় পদে তরুণদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রবীণ একটা প্রজন্ম দল বা সরকারের কোনো দায়িত্বে নেই। তাঁদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা থেকেই নির্বাচিত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বিএনপি ও জাতীয় পার্টি আগেই এ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে সরকারের শরিক ১৪ দলের মতামতই জানতে চায়নি।
জানতে চাইলে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বিমান পরিবহনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ দলে নির্বাচনের বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। আর দল হিসেবে তাঁরা বিবেচনা করে দেখেছেন চেয়ারম্যান পদে তাঁদের প্রার্থীর সুযোগ কম। এ জন্য সদস্য পদে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দলীয় কোন্দলে কোণঠাসা ও অতীতে অন্য নির্বাচনে বারবার চেষ্টা করে দলের আনুকূল্য না পাওয়া কয়েকজন এবার জেলা পরিষদে প্রার্থী করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে প্রার্থী করা হয়েছে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে। ওই জেলায় বর্তমান প্রশাসক আবদুল হাই। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও আনোয়ারকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সেলিনা হায়াৎ আইভীকে মনোনয়ন দেয়। গত মঙ্গলবার গণভবনে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের নেতাদের বৈঠকের একপর্যায়ে আনোয়ার হোসেন ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করতে চান। সিটি নির্বাচনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে আনোয়ারকে জেলা পরিষদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আবদুল হাইকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য তাঁকে জেলা পরিষদে বিবেচনা করা হয়নি।
ঢাকা জেলা পরিষদে বর্তমান প্রশাসক হাসিনা দৌলাকে বাদ দিয়ে মাহবুবুর রহমানকে দেওয়া হয়েছে। তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। প্রশাসক থাকা অবস্থায় হাসিনা দৌলার বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তাঁর অধীনে ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে জেলায় ৬ হাজার ৪৮৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। কিন্তু বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা যায়, এর ৭৭ শতাংশই ভুয়া। এমনও হয়েছে মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তার নামে খরচ দেখানো হয়েছে। কিন্তু ওই এলাকায় সেই প্রতিষ্ঠানই নেই। এসব দুর্নীতির কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন হাসিনা দৌলার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা করেছে।
দলীয় কোন্দলের কারণে মেয়র থাকা অবস্থায় নেত্রকোনা পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন হারান প্রশান্ত কুমার রায়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমীক্ষাতেও প্রশান্তের জনপ্রিয়তার কথা উঠে এসেছিল। এবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে সমর্থন দিয়ে তাঁর ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য জানান।
জয়পুরহাটে দলের প্রার্থী আরিফুর রহমান। সেখানে বর্তমান জেলা পরিষদের প্রশাসক সোলাইমান আলী এবারও দলের সমর্থন চেয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় কোন্দলের কারণে অনেকটা আকস্মিকভাবে আরিফুর রহমান সমর্থন পেয়ে যান।
স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ আল মাহমুদের সঙ্গে সোলাইমান আলীর দ্বন্দ্ব রয়েছে। আল মাহমুদের নিজ জেলা জয়পুরহাট।
বরগুনায় জাহাঙ্গীর কবিরকে বাদ দিয়ে দেলোয়ার হোসেনকে দলীয় প্রার্থী করা হয়েছে। অথচ দলে দেলোয়ারের কোনো পদই নেই। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন নেতা বলেন, দেলোয়ার আসলে দলের রাজনীতির বিরুদ্ধ স্রোতে ছিলেন দীর্ঘদিন। তাঁকে এবার জেলা পরিষদে প্রার্থী করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ের প্রথম মাপকাঠি ছিল যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা। পাশাপাশি দলে অবদান দেখা হয়েছে। এ জন্য যাঁদের নাম আলোচনায় ছিল না, এমন প্রার্থীকেও দল সমর্থন দিয়েছে।
জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার হচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। স্থানীয় সরকারের প্রথম তিন স্তরে নির্বাচন হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। এসব নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জোরজবরদস্তির অভিযোগ ছিল। স্থানীয় সরকারে বিরোধী দলের যেসব জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেককেই হয় বরখাস্ত করা হয়েছে নতুবা কারাগারে আছেন।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের ধরন ও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে এটা পরিষ্কার যে জেলা পরিষদের সব কটিতেই সরকারি দল জিতবে। সে জন্য জেলা পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিচ্ছে না। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি এখন জাতীয় নির্বাচন নিয়েই ভাবছে এবং ওই নির্বাচনটা ভালো নির্বাচন হবে বলেই আশা করছে।
mongsai79@gmail.com

Comments