অভিবাসন চুক্তির জন্য ঐক্য প্রয়োজন

আপডেট: 
আগামী সপ্তাহে ঢাকায় গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (জিএফএমডি) নবম শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ এটি আয়োজন করছে, যেখানে বিশ্বের ১২০টি দেশ, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাতের নেতারা উপস্থিত থাকবেন। এ বিষয়ে বছরব্যাপী যেসব আলোচনা হয়েছে, তার চূড়ান্ত পরিণতি হবে এই ঢাকা সামিটে। এটা এমন এক সময়ে হতে যাচ্ছে, যখন শেষমেশ পৃথিবী অভিবাসনে গুরুত্ব দিচ্ছে, যখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সর্বত্র এটা নিয়ে আলোচনা করছে।
এখনো তিন মাস হয়নি, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেন্টস’ বিষয়ে শীর্ষ বৈঠকে বিশ্বনেতারা নিউইয়র্ক ডিক্লারেশন ফর রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেন্টস গ্রহণ করেছেন। এতে নানা প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, দুটি বৈশ্বিক চুক্তির ব্যাপারে এতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে শরণার্থী–বিষয়ক দায়িত্ব বণ্টন; দ্বিতীয়টি হচ্ছে নিয়মিত, নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল অভিবাসন নিশ্চিত করা। দুই বছর ধরে এ নিয়ে আলোচনা হবে, যা শুরু হবে ২০১৭ সাল থেকে; যেটা ২০১৮ সালে অনুষ্ঠেয় এক সরকারি পর্যায়ের সম্মেলনে গৃহীত হবে।
এ বছরের এপ্রিলে দ্রুত বিকাশমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশই নিরাপদ, নিয়মিত ও সুশৃঙ্খল অভিবাসনের লক্ষ্যে বৈশ্বিক চুক্তির প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে। শেষমেশ বিশ্বনেতারা একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য প্রণয়নে রাজি হন, যেটা অভিবাসীদের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে।
২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই জিএফএমডি বিশ্বসম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে আস্থা, আত্মবিশ্বাস ও পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিতকরণে নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। জিএফএমডি অভিবাসনকে জাতিসংঘের অগ্রাধিকারে তালিকাভুক্ত করার জন্য তাকে সমর্থন ও অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে, যারা বহু দিন অভিবাসনের বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে আমলে নিতে চায়নি।
২০১৫ সালে বিশ্বনেতারা স্বীকার করেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে অভিবাসীদের অবদান আছে, টেকসই উন্নয়নে ২০৩০ এজেন্ডার অংশ হিসেবে তাঁরা এটা করেছেন। তাঁরা নিরাপদ, নিয়মিত, সুশৃঙ্খল ও দায়িত্বশীল অভিবাসন নিশ্চিত ও সহজতর করার অঙ্গীকার করেছেন। এক দীর্ঘ বিতর্কের পর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) জাতিসংঘে যোগ দিয়েছে।
বাংলাদেশ যখন জিএফএমডির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিল, তখন আমরা আন্তর্জাতিক অভিবাসনব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও তৎপর করার কষ্টকর দায়িত্ব কাঁধে নিই।

আজ কোনো সমাজই ক্রমবর্ধমান মানব বৈচিত্র্যের বিষয়টি অগ্রাহ্য করে সমৃদ্ধ হতে পারবে না। এই বৈচিত্র্যময় সমাজে সামাজিক দৃঢ়তা ও একতা অর্জন করার লক্ষ্যে বৃহৎ পরিসরে কেমন নীতি করা উচিত
শেষমেশ সব রাষ্ট্র রাজি হয়েছে, অভিবাসীদের মর্যাদা যা-ই হোক না কেন, তাঁদের মানবাধিকার রক্ষা করা হবে। কিন্তু তাঁদের মানবাধিকার নিশ্চিত করাটাই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। ঢাকায় জিএফএমডির শীর্ষ বৈঠকে অভিবাসীদের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন নীতি নিয়ে আলোচনা হবে, যার মধ্যে আছে অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় অধিকারভিত্তিক মনোভঙ্গি গ্রহণ, অভিবাসন–বিষয়ক সব নীতিতে সুরক্ষা নীতি সংযোজন, বিশেষভাবে অরক্ষিত এমন অভিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা নীতি প্রণয়নে পরামর্শ প্রদান। সংকটের সময় অভিবাসীদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে, তা সে প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট যা-ই হোক না কেন। সম্ভাবনা আছে, নিউইয়র্ক ঘোষণায় (ডিক্লারেশন) অসহায় অভিবাসীদের জন্য নীতিবিষয়ক পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রণয়নে যে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে এটা রসদ জোগাতে পারে।
ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে অভিবাসনের সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যয় কমানোর উপায় অনুসন্ধান করা হবে, যে ব্যয়টা সামঞ্জস্যহীনভাবে স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকদের বহন করতে হয়। একই সঙ্গে, নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের যে ব্যয় হয়, তা কমানোর জন্য কীভাবে ন্যায্য ও নৈতিক নিয়োগ–প্রক্রিয়া চালু করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হবে।
আজ কোনো সমাজই ক্রমবর্ধমান মানব বৈচিত্র্যের বিষয়টি অগ্রাহ্য করে সমৃদ্ধ হতে পারবে না। এই বৈচিত্র্যময় সমাজে সামাজিক দৃঢ়তা ও একতা অর্জন করার লক্ষ্যে বৃহৎ পরিসরে কেমন নীতি করা উচিত, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে এই শীর্ষ বৈঠকে। এ ছাড়া অভিবাসীদের সমাজে অঙ্গীভূত করার ক্ষেত্রে তাঁদের মানবাধিকার ও শ্রমবাজারের প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ কী ভূমিকা রাখতে পারে, তার ওপরও আলো ফেলা হবে।
উল্লিখিত অভিবাসন চুক্তিতে কী থাকতে পারে, তা বোঝার জন্য এই বিবেচনাগুলো আমাদের কাজে আসবে। আমরা বৃহৎ পরিসরে কিছু মানদণ্ডের কথা ভাবতে পারি। ব্যাপারটা এমন হবে যে এই মানদণ্ডগুলো সব অভিবাসীর জন্য প্রযোজ্য হবে, সে তাঁদের মর্যাদা যা-ই হোক না কেন; নতুন সমাজে তাঁদের অঙ্গীভূত হওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে মানুষের এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া নিশ্চিত করা, জাতীয় সীমান্ত অক্ষুণ্ন রেখে অভিবাসন সুশৃঙ্খল করা, অভিবাসী পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই, তাঁদের প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া সহজতর করা, অসহায় অভিবাসীদের কার্যকর সুরক্ষা প্রদান, অভিবাসন ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রভাব সংশ্লিষ্ট সবার জীবনে ছড়িয়ে দেওয়া—এসবও নিশ্চিত করতে হবে।
একই সঙ্গে চুক্তিটি তার ধরনের কারণেও আলাদাভাবে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, যার ফলাফল বিভিন্ন রকম হতে পারে: ১. আইনি বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন রীতি বা চুক্তি, যার দ্বারা রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ন্ত্রিত হবে; ২. রাষ্ট্রের আচরণ কেমন হবে তার জন্য দিকনির্দেশনাসহ রাজনৈতিক ঘোষণা; ৩. পরিষ্কার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সফলতার সূচকসংবলিত কার্যসাধনের সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার, যার সঙ্গে থাকবে মনিটরিংয়ের কাঠামো; ৪. এ তিনটির সমন্বয়, সম্ভব হলে যার মধ্যে থাকবে কাঠামোগত চুক্তি (ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট), যেখানে আবার এ বিষয়ের উপযোগী ইস্যুগুলোর জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে। যেখানে সাধারণ মতৈক্য থাকবে, সেখানে রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকবে, যেখানে সরকার কাজে নামতে প্রস্তুত, সেখানে সুনির্দিষ্ট কাজের অঙ্গীকারের সঙ্গে ফলো আপের পদ্ধতিও থাকবে।
আমরা বিশ্বাস করি, গ্লোবাল মাইগ্রেশন কমপ্যাক্ট গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হলে আমরা যে উপায়ে অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় পারস্পরিক সহযোগিতা করি, তা বদলে যাবে। এতে অভিবাসন নিরাপদ হবে, সমাজ আরও সংহত ও অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
শানে নজুল হলো, আজকের বিকাশমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় কোনো দেশই অভিবাসনের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
মো. শহীদুল হক: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব।

Comments