বিশ্ব মিডিয়াও ভুলে যেতে বসেছে রোহিঙ্গাদের


                  « হাবীবুল্লাহ সিরাজী »
শান্তিতে নোবল বিজয়ী অং সান সু কির দেশে এখন অশান্তি বিরাজ করছে। আর এই অশান্তির পেছনে একচ্ছত্র হাত রয়েছে মিয়ানমারের শান্তিবাদী বৌদ্ধদের। তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হামলাকে যৌক্তিক প্রমাণিত করার জন্য ভুয়া দাবি তুলেছেন যে, এরা অর্ধেক বাংলাদেশী। এই অযৌক্তিক অজুহাতে কয়েক বছর ধরে তারা রাখাইন মুসলমানদের ওপর হামলা করে এদের বাড়িঘর, দোকানপাট, মসজিদ, মাদরাসা জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া লুটপাট ও ধর্ষণের মতো ঘটনা তো ঘটছেই। এরই মধ্যে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কিছু রাখাইন কর্মকর্তা আট রোহিঙ্গা মহিলাকে অপহরণ, হত্যা ও ধর্ষণ করলে রোহিঙ্গারা এর প্রতিবাদ জানায়। এদের ওপরও চলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর যখন আক্রমণ হয়, তখন মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনাবাহিনী দর্শক সারিতে ছিল অথবা তাদের সহায়তা জুগিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ২০১২ সালেই শত শত রোহিঙ্গা হত্যা, দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে করা হয় গৃহহীন। আর বিবিসি শিশুদের পুড়িয়ে মারার দৃশ্যও প্রকাশ করেছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দণি-পূর্ব এশীয় অঞ্চলসহ সারাবিশ্বের Top of the issue নিজ দেশে নির্যাতিত ও পরবাসী রোহিঙ্গা মুসলিম ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি এবং ভাগ্যান্বেষণের আশায় সাগরে ভাসা কিছু বাংলাদেশীকে নিয়ে। যারা এখনো নৌকায় আন্দামান সাগর ও মালাক্কা প্রণালীতে ভাসমান দুঃসহ জীবন-যাপন করছে। যাদের সংখ্যা আট হাজারেরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে ভেসেছিল এসব বাংলাদেশী। আর মিয়ানমার সরকার ও বৌদ্ধদের নির্যাতনে সাগর পাড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ভাসমান রহিঙ্গাদের সংখ্যাও প্রায় অর্ধেক। মিয়ানমারে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার [UNHCR] একটি প্রতিবেদনে বলা হয়ছে,জীবন বাঁচাতে গত তিন বছরে এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছে; যাদের ২০ হাজারই দেশান্তরী হয়েছে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে। ভাসমান এ অবৈধ অভিবাসী ও রোহিঙ্গাদের জাতিসঙ্ঘের আহ্বান উপো করে ভিড়তে দিচ্ছে না থাইল্যান্ড, মালায়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী। ফলে সেখানে খুবই বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। এবিসি অনলাইন-রেডিও অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে,সাগরে যাত্রাকালেই প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে আর এদের বেশির ভাগের মৃত্যু হয়েছে ুধা-তৃষ্ণা এবং নির্যাতনে। এমনকি খাবার নিয়ে মারামারিতেই প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে। গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, সাগরে অনেকে অপুষ্টিতে প্যারালাইজড হয়ে গেছে, বাকিরাও যেন একটি জীবন্ত কঙ্কাল। তারা কখনো অথৈ সমুদ্রে, কখনো রোদে পুড়া আবার কখনো বৃষ্টিতে ভিজছেন। খাবার নেই, পানি নেই। নিজেদের মূত্র পান করেও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন অনেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণহত্যা স্মৃতি জাদুঘর ‘They want us all to go away early warning sines of genoside in Burma’ নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, কিভাবে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ঘৃণামূলক বক্তৃতা দেয়াসহ, শারীরিক নির্যাতন, ভয়াবহ জীবন-যাপন, ভূমি বাজেয়াফত করা, যৌন সহিংসতা, নাগরিকত্ব হারান, চাঁদাবাজি ও মানবতাবিরোধীসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়। আর জাতিসঙ্ঘ এদের ‘ভাসমান কফিন’ বলে উল্লেখ করেছে। University of London Gi Queen Mary Institute-এর একদল গবেষক নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে গত কয়েক মাসের অবস্থা বিবেচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে, যা Professor Pany Green প্রকাশ করেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের সামনে দু’টি পথ আছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। এক. দেশে অবস্থান করে ধীরে ধীরে নির্মূল হওয়ার জন্য অপো করা। দুই. পলায়ন করে সমুদ্রে ভেসে আশ্রয় নেয়া। এই নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে জাতিসঙ্ঘ ‘The most persecuted people on the earth’ (পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
তবে সর্বশেষ সুখবর হলো, কুয়ালালামপুরের বৈঠকে থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুরাপঙ, ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাতালোগোয়া ও মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফা আমিন ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, তারা সাময়িকভাবে হলেও ভাসমান সব জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেবেন। আর তুরস্কের সফল বিপ্লবী মুসলিম নেতা রজব তাইয়েব এরদোগান ভাসমান সব জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারের জন্য একটি বিশালাকার জাহাজ পাঠানোর নির্দেশ এবং তাদের খাবার ও চিকিৎসার জন্য এক মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
এই রোহিঙ্গা নিধন আন্দোলনের কলকাঠি নাড়ছে বৌদ্ধদের চরমপন্থী সংগঠন ‘969 movement of Buddism। এই সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন উইরাথু নামের বৌদ্ধভিক্ষু; যিনি ২০০৩ সালে মুসলিমবিরোধী প্রচারণায় সাত বছর জেলে ছিলেন। উইরাথু নেতৃত্বাধীন সংগঠনের মূলমন্ত্র হলো ‘Buddists to fraternize only among themselves’ অর্থাৎ ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক শুধু তাদের মধ্যেই চলবে। তারা মনে করে, তদের ধর্ম বিলুপ্ত হচ্ছে। ইসলাম ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান, চীনের উইঘুর দখল করে নিয়েছে, যা পূর্বে বৌদ্ধদের আবাসভূমি ছিল। তাদের আশঙ্কা মিয়ানমারে মুসলিমদের সংখ্যা যেহারে বেড়ে যাচ্ছে তাতে এই দেশও একদিন ইসলাম দখল করে নেবে। এরই আরেক সহযোগী সংগঠন Bodu Bala sena (BBS), যারা শ্রীলঙ্কায় তৎপরতা চালাচ্ছে এবং ইসলামকে শ্রীলঙ্কা থেকে বিতাড়িত করার ব্যর্থ অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আর এসব অযৌক্তিক সংগঠনের চাপে মিয়ানমার সরকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘দু’সন্তান নীতি’ চালু করেছে।
এখন রোহিঙ্গাদের উৎপত্তি নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। রোহিঙ্গা শব্দটি রৌহিঙ্গা বা রোহিঙ্গিয়া শব্দ থেকে এসেছে, যা ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা। আর এই ভাষার সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষার রয়েছে অবিশ্বাস্য মিল এবং বাংলার সাথে কিছুটা। তবে রোহিঙ্গা ঐতিহাসিক খলিলুর রহমান বলেন : রোহিঙ্গা শব্দটি ‘রাহমা’ শব্দ থেকে এসেছে। অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকদের জাহাজ ‘রামরি দ্বীপ’-এ এলে তৎকালীন আরাকানের রাজা তাদের আশ্রয় দেন। তার এই দয়ার কারণে আরব বণিকেরা আরাকানের অধিবাসীদের ‘রাহমা’ বলে ডাকতেন। (যেহেতু রাহমা অর্থ দয়াবান)
এম চৌধুরীর মতে, ‘ম্রৌহাঙ্গ’ শব্দ থেকে রোহিঙ্গা শব্দটির আগমন। আর ম্রৌহাঙ্গ ছিল আরাকানের পুরাতন রাজা। বার্মিজ ঐতিহাসিক খিন মৌং বলেন : ‘১৯৫০ সালের পূর্বে রোহিঙ্গা শব্দটি অপরিচিত ছিল। তবে তারা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা।’ ড. মৌং মং বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এখানকার স্থায়ী অধিবাসী এবং ম্রৌক উং-এর সাম্রাজ্যকাল থেকেই তারা এখানে স্থায়ী বাসিন্দা।’ Arakan History expert Dr. Jacues P. Leider বলেন : ১৭৯৯ সালে বৃটিশ লেখক ফ্রান্সিস বুসানান হ্যামিলটনের প্রকাশিত বইয়ে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘রোহিঙ্গারা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা।’
আরাকানি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে যে, তৎকালীন মুসলিমপ্রধান ভারত ও বৌদ্ধপ্রধান বার্মার ইতিহাসের মধ্যে চাপা পড়ে গেছে আরাকানের ইতিহাস। যদি ১৪৩০ সালে বাংলার মুসলিম সুলতান ৬০ হাজার সৈন্যের বাহিনী পাঠিয়ে বৌদ্ধ রাজা Narameikhtla কে আরাকানের সিংহাসনে না বসাতেন, তবে আরাকানের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। সেদিন ওয়ালি খানের নেতৃত্বে বাংলার সুলতান অভিযান প্রেরণ করে Narameikhtla কে সিংহাসনে পুনর্বহাল করেন। কিন্তু ওয়ালি খান সিংহাসন নিজের জন্য দাবি করে বসেন। পরে আবার জেনারেল সান্দি খানের নেতৃত্বে আরেকটি অভিযান প্রেরণ করে ওয়ালি খানকে সিংহাসনচ্যুত ও Narameikhtla কে সিংহাসনে পুনর্বহাল করা হয়। যদি বাংলার সুলতান ওয়ালি খানকে আরাকান শাসন করতে দিতেন তাহলে আরাকানের ইতিহাসে কী দাঁড়াত? রোহিঙ্গাদের ওপর এই চতুর্মুখী নির্যাতনের প্রতিবাদ সব মুসলিম দেশ করলেও আমাদের দেশ ছিল দর্শক সারিতে। যেখানে সিরিয়া শরণার্থীদের তুরস্ক আশ্রয় দিয়েছে। ফিলিস্তিনের অসহায়দের মিসর আশ্রয় দিয়েছে, সেখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশের মুসলমানদের আশ্রয় দিতে এ দেশের মুসলিম সরকার অমুসলিমের মতো আচরণ করেছে। কিছু কিছু রোহিঙ্গা সাগরে ভেসে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে আশ্রয় নিলেও সরকার তাদের পুশব্যক করেছে। আর আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা সংখ্যালঘুদের ওপর চুলের আঁচড় লাগলেই তারা তিল থেকে তাল করে বসেন এবং সাম্প্রদায়িক বলে, গলা ফাটিয়ে ফেলেন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের এমন খড়গ নামলেও তারা না দেখার ভান করে ‘ভেজা বিড়াল-এর মতো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। নৌকায় ভাসমান মানুষগুলো মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গা কিংবা বাংলাদেশী বলেই কি এত অবহেলা! কী অদ্ভুত বিশ্বের সভ্য মানবতা! আবার কোনো কোনো দেশ শুধু বিবৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন OIC রোহিঙ্গাদের এমন দুরবস্থা দেখে না দেখার ভান করার হেতু কী, তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। অপর দিকে আরব লিগের শেখরা আমেরিকা-ইহুদিদের পা-চাটা গোলামের মতো নিশ্চিন্তে বসে আছেন। আর সৌদি-আরব তো ইয়েমেনবাসীর ওপর আক্রমণ করার জন্য ইসলামবিদ্বেষীদের গায়ে তেল মর্দন করায় ব্যস্ত।
সারা বিশ্বের মুসলিমদের এমন দুরবস্থা আর ক্ষমতার মোহে ঘুমন্ত কিছু দেশের নীরবতা দেখলে মুসলিম হিসেবে নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য কিছু করতে না পারার সীমাহীন লজ্জায় সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে পরিচয় দিতে নিজেকে কুণ্ঠাবোধ করি। তাহলে কী বিরোধী শক্তি সর্বদা ষড়যন্ত্রের অট্টহাসি হেসেই যাবে আর আমরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে সারা জীবন কেঁদেই যাবো?

Comments