চোখ ভিজে আসে চোখ ভেসে যায়

আসছে ২৭ ডিসেম্বর সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিন। মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম জন্মদিন। সৈয়দ হক চলে গেছেন এ বছরই। মৃত্যুর পর কবির জন্মদিনের ক্ষণে তাঁকে নিয়ে প্রথমবারের মতো কলম ধরেছেন তাঁর সহধর্মিণী

এই সামান্য লেখাটি আমাদের দেশের আপামর জনগণ এবং জনগণের সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আন্তরিক একটি প্রচেষ্টামাত্র। দীর্ঘদিন নীরব থাকবার পর আমার এই সরবতাকে দেশের কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার-সাংবাদিক-মিডিয়া ও জনগণ ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কারণ, হঠাৎ করে যে ধস নেমে এসেছিল আমার ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ ও পরিবেশেও। তার ধাক্কা সামলাবার মতো মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিল না। ফলে কবি ও সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের আচমকা প্রয়াণের আগের ও পরের মুহূর্তগুলো আমার কাছে এখনো অস্পষ্ট ও অসংবদ্ধ অবস্থায় গ্রথিত হয়ে আছে। আমি এখনো জানি না, স্বপ্নের ভেতরে আছি, না জাগরণে। বাস্তবের বিকট করাল দাঁত আমাকে কীভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে ফেলছে, সেটিও এখন অবধি সম্যক উপলব্ধিতে আনতে পারিনি আমি। তাঁর অসুস্থতার সময় আমি যেন এক ঘোরের ভেতরে পতিত হয়েছিলাম। দেশ বা বিদেশ আমার কাছে সমান হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। জীবনের দাবি বড় নির্দয়, কখনো-বা নিষ্ঠুর বলে মনে হয়। জীবন এগিয়ে চলে; সে দাবি করে সেই মুমূর্ষু মানুষটির কাছেও, যতক্ষণ তার নিশ্বাস বাতাসে ঘূর্ণিত হচ্ছে ক্রমাগত। এই দাবির কাছে আমাকেও উঠে বসতে হয়। হাতে তুলে নিতে হয় কলম। এর চেয়ে যদি হতাম আটপৌরে একজন গৃহিণী, তাহলে কবির জন্য মাতম করে দিন কাটাতে পারতাম, যা সর্বক্ষণই আমার করতে ইচ্ছে করে। অথবা কবি হয়তো নিজেই জানতেন, আমাকে তিনি ভেসে যেতে দেবেন না। হারিয়ে যেতে দেবেন না আমাকে। আবার আমাকে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর কথা ভুলতে দেবেন না। আমাকে চলমান রাখবেন।
আমাকে একা ফেলে যাবার কতই-না ভয় ছিল তাঁর। অথচ আমি এখনো বেঁচে আছি, এই পৃথিবীতে শ্বাস নিচ্ছি এখনো!
২.সৈয়দ শামসুল হকের অকস্মাৎ অসুস্থতার পর যখন তাঁকে লন্ডনে নিয়ে গেলাম, প্রায় একা তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে সবকিছু সামাল দেবার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি আমি। কারণ, বিদেশের মতো জায়গায় এর কোনো বিকল্প ছিল না। আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব—যাঁর যতটুকু করার কথা, সাধ্যমতো সবকিছু করেছিলেন। তবু নির্জনতার পাথারে শুধু তিনি আর আমি। কেবল কালক্ষেপণ এবং আগামীর দিকে তাকিয়ে থাকা। তার ভেতরে ক্রমাগত তাঁকে উৎসাহ দিয়ে যাওয়া বুকের ভেতরে অশ্রুর ঢল চেপে; এবং হাসিমুখে তাঁকে বলা যে তাড়াতাড়ি আরও তাড়াতাড়ি, আরও দ্রুত, আরও, আরও...। কেননা চিকিৎসকও তাঁকে এই কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন দ্রুততার সঙ্গে তাঁকে সবকিছু সারতে হবে। কিন্তু এ কথা বলবার পরও তাঁর ভেতরে একটা অদ্ভুত আলস্য বা নির্বিকার আবস্থা দেখেছিলাম। তিনি আমার ছোট বোন লন্ডনপ্রবাসী ফাতেমার লাইব্রেরিতে থাকা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পুরো ভলিউম তাক থেকে নামিয়ে পড়তে আরম্ভ করেছিলেন, যেন তাঁর কোনো তাড়া নেই। দোকানে গিয়ে কিনে এনেছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য মুভবেল ফিস্ট, পড়েছিলেন সেটাও। তারপর তাক থেকে নামিয়ে পড়েছিলেন সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত সন্দেশ। আর ফাঁকে ফাঁকে তাঁর হ্যামলেট নিয়ে চিন্তাভাবনা। হাসপাতালে গিয়ে বইয়ের দোকান থেকে আমাকেও বই কিনে উপহার দিয়ে নিজের হাতে আমার নাম লিখেছিলেন। আমি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। কেননা যেকোনো সময় ঘাতক ব্যাধি তাঁর কোটি টাকা দামের করোটির ভেতরে আশ্রয় নিতে পারে, গোপনে, চতুরতার সঙ্গে। তখন? তবে মুখ ফুটে এ কথা তাঁকে বলতে পারিনি! আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল। ভেতরে-ভেতরে আমার খুব তাড়াহুড়োও চলছিল। তাঁর মাথার ভেতরে এতসব লেখা, সেগুলোর কী হবে? নতুন একটা উপন্যাস—একেবারে নতুন ধরনের প্রেক্ষাপটে, যা এর আগে বাংলা সাহিত্যে কেউ লেখেননি—তাঁর মাথার ভেতরে নাড়াচাড়া শুরু করল। একদিন নিজের ওপরেই রাগ করে বলে উঠলেন, আঃ, এখনো কেন আমার মাথার ভেতরে এইসব এসে জড়ো হয়? এখনো কেন আমার মনে হয়, এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে অভূতপূর্ব একটি সংযোজন হবে? এখন-যখন তিনি নেই—প্রায়ই আক্ষেপ হয় এই ভেবে যে তাঁর কাছ থেকে সেদিন কেন ওই উপন্যাসটির পটভূমি জানতে চাইলাম না!
৩.
তাঁর হঠাৎ তিরোধানের পর আমি ও আমার পরিবারের মানুষজন অবাক বিস্ময়ে দেখেছি, কবি ও সব্যসাচীর প্রতি দেশের মানুষের অপরিমেয় অনুরাগ ও ভালোবাসা। তাঁকে শহীদ মিনারে নেওয়ার দিন সকালে রাস্তার দুপাশে সাধারণ মানুষ ও গুণগ্রাহীদের নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য আমাদের অশ্রুময় চোখকে আরও অশ্রুপ্লাবিত করেছে। তাঁর নশ্বর দেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানতে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি থেকে মন্ত্রীবর্গ ও সচিব; কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী-নাট্যকার, চলচ্চিত্রের মানুষজন, মিডিয়া এবং সাংবাদিক থেকে গার্মেন্টসকর্মী, শ্রমিক সংঘ, সাধারণ নাগরিক—সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন। ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন এক রিকশাচালকও। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য আমরা সবাই অশ্রুসজল চোখে দেখেছি। এ​েত সামান্য হলেও দুঃখভার লাঘব হয়েছে আমাদের।
৪.
ধন্য এই কবি ও সব্যসাচীর জীবন। একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশের অধিবাসী হয়েও তাঁর কৃতকর্মের প্রতি মানুষের যে আবেগ ও ভালোবাসার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, তা বিশ্বের যেকোনো উন্নত দেশের কবি-সাহিত্যিক বা শিল্পীর জন্য ঈর্ষাবহ। কবির জন্মগ্রাম কুড়িগ্রামের মানুষ তাঁকে যেভাবে সাদরে বরণ করে নিয়েছেন, তাঁর শেষ ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কুড়িগ্রাম কলেজের উন্মুক্ত প্রান্তরে তাঁকে সমাহিত করেছেন, সে জন্য তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কুড়িগ্রাম কলেজের মাঠের ওপরে আকাশে যখন কবির নশ্বর দেহ হেলিকপ্টারে ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং নিচে চোখ ফেলে আমরা যখন হাজার হাজার মানুষকে ঊর্ধ্বমুখে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম, অশ্রুসজল হয়ে উঠছিল আমাদের চোখ। সৈয়দ শামসুল হকের জীবন ধন্য যে তিনি জন্মেছিলেন এমন এক দেশে, যেখানে ১৬ কোটি মানুষের প্রায় অধিকাংশই তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। দেশের প্রতিটি সংবাদপত্র, মিডিয়া, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কবির জীবনব্যাপী নানা কর্মকাণ্ডের যে বিপুল ক্যানভাস, তা সবার সামনে বারবার ধরেছেন। মনে পড়ে, কবির অসুস্থতার সেই দিনগুলোতে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও যুক্তরাজ্যের নানা জায়গা থেকে সর্বক্ষণই টেলিফোন আসত, যা সামাল দেবার ক্ষমতা আমদের ছিল না। ক্রন্দিত মানুষের গলার স্বর সৈয়দ হককে কতই-না আলোড়িত করেছে দিনের পর দিন!
৫.
যাপিত জীবনে তিনি কতবার করেই না নিগৃহীত হয়েছেন তাঁর সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী বন্ধুদের হাতে। কতই না ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এবং এ জন্য তাঁর পরিবারের কাছেও কত-না অবমাননার শিকার হয়েছেন। আমাদের চোখের আড়ালে কতই-না নীরব রক্তক্ষরণ হয়েছে তাঁর। নির্জনতার মিছিলে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত একাকী হেঁটে গেছেন। কিন্তু এ পৃথিবী ছাড়ার আগে তাঁর সব ক্ষোভ, সব দুঃখ মুছে গেছে। তিনি যেমন দেখে গেছেন তাঁর ইংরেজ বন্ধু সাহিত্যিক-সাংবাদিক জেরেমি সি ব্রুকের ভালোবাসা, তেমনি স্বচক্ষে দেখে গেছেন তাঁর প্রতি প্রত্যেক বাঙালির ভালোবাসা। কত মানুষ কতভাবেই না ভালোবেসেছেন তাঁকে! দিল্লির এক বাঙালি লেখক সৈয়দ হকের কাছে টেক্সট পা​িঠয়েছিলেন এই লিখে, ‘দাদা, আমি ঈশ্বরের কাছে রোজ প্রার্থনা করি এই বলে যে আমার যতটুকু আয়ু ঈশ্বর বরাদ্দ করেছেন, তার ভেতর থেকে কিছু আয়ু আপনাকে দেবার জন্য। আপনি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকুন, দাদা।’
এখন যখন স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে, ভিজে উঠছে আমাদের চোখ। আমাদের চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। সময়ের অগ্রগামী এই কবিকে বড় আদরে গ্রহণ করেছে তরুণ প্রজন্ম।
৬.
চোখ ভেসে যায়—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমাদের চোখ ভিজে ওঠে। কর্কটের ছোবলে যখন আমরা দিশেহারা, হঠাৎ আর্থিক অনটনে হতভম্ব, বিপর্যস্ত, বাস্তবের নিষ্ঠুর কশাঘাতে রক্তাক্ত, ছিন্নবিচ্ছিন্ন ও হতবাক; তখন মায়াময়ী, স্নেহময়ী জননী হয়ে, ভগিনী হয়ে তাঁর দুটি হাত তিনি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই দুঃসময়ে তিনি যেভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাদের প্রতি, তা নিশ্চিতই এক জীবনে শোধ করা যাবে না।
সৈয়দ হকের শেষ দিনগুলোতে যিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের সার্বক্ষণিক আশ্রয়, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলকেও এই ক্ষণে মনে পড়ছে। হায়! তিনিও যে চলে গেলেন মাত্রই, অকালে।
কেবলই চোখ ভিজে যায় আমাদের, অশ্রুর বন্যায় চোখ ভেসে যায় এ কথা ভেবে যে একজন কবিকে দেশ এভাবে ভালোবাসতে পারে! এ জন্য দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি আপ্লুত আমরা।
৭.
আবারও এসেছে ডিসেম্বর। প্রতিবছরই ডিসেম্বর আসে, আসবে। ১৯৩৫-এর ২৭ ডিসেম্বরে জন্মেছিলেন কবি। বেঁচে থাকলে এই ২৭ ডিসেম্বর একাশি পেরিয়ে বিরাশিতে পা দিতেন। তিনি লালন সাঁইয়ের সমান আয়ু চেয়েছিলেন। পাননি। তাঁর বিরাশিতম জন্মদিনের আগেই ছবি হয়ে গেলেন তিনি। এবারের ২৭ ডিসেম্বর হয়তো আমাদের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হবে—কবিকে ছাড়া এবারই প্রথম পালিত হবে তাঁর জন্মদিন। বরাবরই নীরবে জন্মদিন পালনের পক্ষপাতী ছিলেন সৈয়দ হক—কখনো সেটি সম্ভব হতো, অধিকাংশ সময়ই হতো না। তাঁর জন্মদিনে কত মানুষ শুভেচ্ছা জানাতে আসতেন কবিকে! সেই স্মৃতিগুলো কেবলই মনে পড়ছে আর চোখে জল জমে উঠছে আবারও।

Comments