উপড়ে ফেলা হচ্ছে আটককৃতদের নখ গুলিতে নিহত রোহিঙ্গারাই ভাগ্যবান?



« রবি হোসাইন »
বিজিপির তিনটি পুলিশ পোস্টে হামলার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে মিয়ানমারের উত্তর মংডু এবং রাথারডং শহরতলীতে শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানকে আটক করে সেনাবাহিনী। গত ৯ অক্টোবর থেকে এই অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পাশাপাশি সেনাবাহিনীর নৃশংস পরিকল্পিত হামলায় কয়েকশত রোহিঙ্গা নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্রগুলো জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং মংডুর জেলা কোর্টের রায়ে দীর্ঘমেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে কোন প্রকার আত্মসমর্থনের সুযোগ দেওয়া ছাড়াই।
এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘অভিযুক্তদের’ আদালতেই তোলা হচ্ছে না অথবা তারা জানতেই পারছে না তাদের কি অপরাধ,  কেনইবা তাদের দীর্ঘমেয়াদি সাজা দেয়া হচ্ছে।
ন্যায় বিচার পাওয়া অথবা আইনজীবী নিয়োগ করা দূরবর্তী ব্যাপার; আটককৃতদের একটি বদ্ধ ভ্যানে মংডুর জেলা কোর্টের সামনে রাখা হচ্ছে। তারা জানতেই পারছে না কারা আইনজীবী অথবা কোন বিচারক তাদের বিচার করছে। তারা শুধু জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য বিচারকের সাথে দেখা করতে যায় আার বিচারক দ্রুত দীর্ঘমেয়াদি কারাভোগের রায় দেয়।
গত ৯ অক্টোবর থেকে মংডু ও রাথারডং এলাকায় সেনাবাহিনী পরিচালিত ‘রিজন ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ এ প্রায় ৬০০ নারী/পুরুষ আটক হয়েছে।
মংডুভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক ইউ আই মিন্ট বলছে, বুথিডং জেলে পাঠানোর আগেই তাদের আটক করে কিয়াকানপিয়ান বিজিপি হেডকোয়ার্টারে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়েছে।
ডিসেম্বর ১৬ খেকে ২২ তারিখের মধ্যে  প্রায় ৬০০ জনের মধ্যে ৮০ কিংবা ২০০ এর অধিক ব্যক্তিকে ২০ থেকে ২৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।
তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা নৃশংসতাকারী ব্যতিরেকে কারোরই জানা নেই প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিন কত ব্যক্তিকে দীর্ঘমেয়াদি সাজা দেওয়া হচ্ছে। তথাকথিত আদালতের কার্যক্রম যেদিন পরিচালিত হয় সেদিন বিজিপি আদালতে যাওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে রাখে ফলে কেউ তথ্যের জন্যে আদালতে যেতে পারে না।
বিশেষ করে নতুন আটকের শিকার ব্যক্তিদের বর্তমান অবস্থা জেলের কর্মীদের থেকে যারা জেলে দেখাশোনার কাজ করত অথবা যারা সদ্য জেল থেকে বেরিয়েছে তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ক বেশকিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের পুলিশ বলছে, তারা কত বছরের জন্যে কারাভোগ করবে। তারপর তাদের নেয়া হচ্ছে বুথিডং কারাগারে স্পষ্টত যেখানে তাদের তথাকথিত আদালতের রায় শোনার জন্যে নেয়া হয়।
উদ্বেগের বিষয় হলো, উত্তর মংডুতে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার ও আটক ক্রমাগত বেড়েই চলছে। আটককৃতদের ওপর এই নির্যাতন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারের আর্ন্তজাতিক আইন অগ্রাহ্য করা ও যেটা মানবতাবিরোধী অপরাধ।
বুথিডং জেল থেকে কিছু ব্যক্তি সম্প্রতি ছাড়া পেয়েছে; যারা বলেছেন, আমরা মনে করি যে সেনাবাহিনীর অভিযানে যেসব রোহিঙ্গাদের দেখামাত্রই গুলিতে মারা গেছে তারা ভাগ্যবান। তাদের অবস্থা দেখে কেউ সহ্য করতে পারবে না। তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার। জিজ্ঞাবাদের সময় তাদের তীব্র নিযার্তন করা হচ্ছে।
আটক ব্যাক্তিদের নখ ও দাঁড়ি কেটে ফেলা হচ্ছে।  শরীরে বিভিন্ন ক্ষত ও কাটা রয়েছে। তারা বলছে, অজ্ঞাত অভিযোগে তাদের ২০ বছরের জেল দেয়া হয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে তারা তিন বছরের মধ্যেই মারা যাবে।
এই অবাধ গ্রেফতার আর্ন্তজাতিক আইনে নিষিদ্ধ এবং এটাকে আর্ন্তজাতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন ঘোষণার ৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ঘোষণা করেছে, কাউকে অবাধ গ্রেফতার বা আটক বা নির্বাসন দেয়া যাবে না।
যদিও মিয়ানমার সরকার তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া দ্বারা রিপোর্ট প্রকাশ করছে কর্তৃপক্ষ আটক ব্যক্তিদের আইনানুসারে গ্রেফতার করছে এবং অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হচ্ছে।
একাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ মায়ানমার সরকার পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করছে।
মায়ানমার সরকার সামাজিক গণমাধ্যমে ঘোষণা করেছে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠী যারা উত্তর মংডুর জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে, তারাই বর্ডার গার্ড পুলিশের তিনটি চেকপোস্টে হামলা চালিয়েছে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যাদের মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশ আটক করছে তারা সাধারণ নাগরিক এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে যা বিদ্রোহী গ্রুপের আক্রমণের পর শুরু হয়েছে।
সাধারণ জনগণকে অক্ষম করে দেয়ার জন্যে নির্বিচারে গণ-গ্রেফতার, নির্যাতন ও দীর্ঘমেয়াদে সাজার পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে একটি পক্ষপাতিত্বমূলক বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে। যেটা পরিস্থিতিকে আরো ভয়ংকর করে তুলছে। যাদের স্বজনেরা জেলে আটক তাদের কাউকেই স্বজনের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।
মায়ানমার সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এ বছর ডিসেম্বর ৯ তারিখ থেকে অক্টোবর ৯ তারিখ পর্যন্ত মংডুতে ৫৭৫ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। যদিও সরকারিভাবেই এই সংখ্যাটা অবিশ্বাস্যভাবে বেশী। প্রকৃত সংখ্যাটা এই সরকারি ভাষ্যের দ্বিগুণও হতে পারে। কারণ সরকার শুধু তাদের সরকারি বাহিনী দ্বারা তৈরি ক্ষতিগ্রস্থদের কথা স্বীকার করছে।
মায়ানমারর সরকারি বাহিনী দ্বারা একটি জনগোষ্ঠীর ওপর গণহতার ওপর রিপোর্টগুলো পড়ে একজন এই প্রশ্ন  করবেই, মিয়ানমারে কি সত্যিই আইনের শাসন আছে? যেটা রাজ্যের কাউন্সিলর অং সান সুচি গর্বভরে বলতে পছন্দ করেন?

Comments