রুখে দাঁড়াতে জেগেছে অনলাইন বিশ্ব রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ সুচির নির্দেশেই!



« জয়নাল আবেদীন »
টেকনাফের অনিবন্ধিত লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘুরেফিরে নির্মমতার কাহিনিই উঠে আসছিলো অনুপ্রবেশকারী নারী-পুরুষের বর্ণনায়। তাঁদের বেশিরভাগের দাবি, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চলমান নিপীড়নের বিষয়ে অং সান সুচির নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ।
কেউ কেউ বলছিলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার প্রেক্ষিতে সুচি কেবল নীরব নন, বরং এসব ঘটনায় তারই ইন্ধন রয়েছে। অথচ এই সুচির জন্য রোহিঙ্গারা অন্তপ্রাণ ছিলেন বলে জানান তারা।
সুলেমান (৫৫) নামে এক রোহিঙ্গা বলছিলেন, অং সান সুচি যখন গৃহবন্দি, বহু রোহিঙ্গা তখন তার জন্য কেঁদে মরেছেন। সুচির নোবেল প্রাপ্তিতেও সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন তারা। সর্বশেষ গত বছরের নির্বাচনে সুচির দল ক্ষমতায় আসলে আশাটা আরো বড় হয়ে যায়। কিন্তু শেষ অবধি সবকিছু হিতে বিপরীত।
গত ২৪ অক্টোবর থেকে রাখাইন রাজ্যে নৃশংস হামলা চালিয়ে আসছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অভিযোগ রয়েছে, সৈন্যদের সঙ্গে স্থানীয় মগ (বৌদ্ধ) সম্প্র্রদায়ের লোকেরা অস্ত্রহাতে গ্রামে নেমে পড়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে অগ্নিকাণ্ড, প্রকাশে হত্যা, ধর্ষণের মতো নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গত তিন মাসের বেশি সময়েও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
Myanmar Suu Kyi Silence
এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। বেসরকারি হিসেবে ইতোমধ্যে অনুপ্রবেশের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নির্যাতনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একপ্রকার নীরব। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক মিয়ানমারের সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যদিও বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছিলো, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে বাংলাদেশই সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে চুপ থাকলেও আরেকটি পক্ষ তুমুলভাবে ঝড় তুলেছে অনলাইনে। বিশেষ করে অং সান সুচির নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবিতে নরওয়ের নোবেল কমিটির কাছে করা অনলাইন আবেদনটি সাড়া ফেলেছে। অনলাইন পিটিশন দাখিল করা হয়েছে স্বয়ং সুচির কাছেও। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিভিন্ন দেশ থেকে অনলাইনে আবেদনের মাত্রা বাড়ছে।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে এমার্সন যুন্থো নামের এক নারী সুচির পুরস্কার প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছিলেন নোবেল কমিটির কাছে। ‘চেঞ্জ ডট ওআরজি’তে করা আবেদনে সমর্থন জানিয়ে সই করছেন সারা বিশ্বের মানুষ। মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৫ টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ওই আবেদনে সই করেন ২ লাখ ৬ হাজার ৬০৬ জন।
‘চেঞ্জ ডট ওআরজি’তে কেবল নোবেল বিষয়ে নয়, পিটিশন দাখিল করা হয়েছে সুচি এবং রোহিঙ্গা ইস্যু ঘিরে আরো নানা বিষয়ে। জাতিসংঘ বরাবর আলেক্সান্ডার নামের একজন আবেদন করেন। রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নিষ্ঠুরতা বন্ধে রাখাইনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর আবেদন করেন তিনি।
অং সান সুচিকে দেওয়া হার্ভার্ড হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেন ইংল্যান্ড থেকে ডা. খুরশিদ ইবনে ফায়াজ। এ ছাড়া, বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে এ ধরনের আবেদন করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরবতা ভাঙতে সুচির কাছেই আবেদন করেছেন আমেরিকাস্থ বার্মা টাস্ক ফোর্স। তাদের আবেদনে উল্লেখ করা হয়- ‘ভাঙো নীরবতা, থামাও গণহত্যা (ব্রেক দ্য সাইলেন্স, এন্ড দ্য জেনোসাইড)’।
জাকার্তা থেকে নোবেল প্রত্যাহার চেয়ে করা আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষায় যারা কাজ করেন, তাদেরকেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের মতো সর্বোচ্চ পুরস্কার দেয়া হয়। সুচির মতো যারা এই পুরস্কার পান, তারা শেষ দিন পর্যন্ত এই মূল্যবোধ রক্ষা করবেন, এটাই আশা করা হয়। যখন একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হন, তখন শান্তির স্বার্থেই নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির উচিত এই পুরস্কার হয় জব্দ করা নয়তো ফিরিয়ে নেয়া।’
১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সু চির বিরুদ্ধে পিটিশনগুলো করার কারণ হলো রোহিঙ্গা মুসলিম প্রশ্নে তার নীরব অবস্থান। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরেই রাষ্ট্রীয় ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়ে বরাবরই নিশ্চুপ থেকেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এ নেত্রী। সুচির এমন আশ্চর্যজনক নীরবতা তার অনেক কট্টর সমর্থকের মনেও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পদার্পণের ঐতিহাসিক নির্বাচনে সুচির দল কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে প্রার্থী না করার পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আল জাজিরা তুলে আনে মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন নিয়ে সুচির ধারাবাহিক নীরবতার প্রশ্ন।
এতকিছুর পরেও সুচিকে নিয়ে খুবই আশাবাদি ছিলেন রোহিঙ্গারা। এমনকি অক্টোবর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নিপীড়নের বিষয়েও সুচি ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন বলে আশা করেছিলেন তারা। কিন্তু শেষপর্যন্ত সুচিকে পাশে পাননি রোহিঙ্গারা।
বরং তাদের অভিযোগ, নৃশংসতা চলার মধ্যেই সুচির পক্ষে একজন নেতা রাখাইনে এসে সহিংসতায় উসকানি দিয়ে গেছেন। সুচির বরাত দিয়ে ওই নেতা নাকি নির্দেশ দিয়ে গেছেন, যত দ্রুত সম্ভব রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে হবে।

Comments