মুক্তিযুদ্ধ বিরাজের চিত্রশালা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করার পর প্রতিবাদে, দুঃখ ও ক্ষোভে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিলেন শ্রীমঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধা বিরাজ সেন। ১৯৭৯ সালে গোপনে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে পাসপোর্ট করে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির বনে চলে যান। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে যান যুক্তরাষ্ট্রে।

২০০৮ সালে বাংলাদেশে ফিরে নিজেকে জড়িয়ে নেন দেশের কাজে। শ্রীমঙ্গল-শমশেরনগর সড়কের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সেক্টর কমান্ড কাউন্সিল-সংলগ্ন সাধু বাবার থলিখ্যাত বধ্যভূমি (এখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরেরা অসংখ্য নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল) সংরক্ষণের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ কাজে সহায়তা করেছেন তৎকালীন বিজিবির ১৪ নম্বর ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল নুরুল হুদা। এ স্থানটি এখন বধ্যভূমি-৭১ নামে পরিচিত।
শ্রীমঙ্গলের পুরান বাজারে নিজের বাড়িতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন জাগৃতি শিল্পীগোষ্ঠীর পাশের ঘরে গড়ে তোলেন ‘সম্প্রীতি চিত্রশালা-৭১’। ১০ বাই ১৫ ফুটের এই ঘরের চার দেয়ালে পরিপাটিভাবে সাজিয়েছেন পাঁচ শতাধিক স্থিরচিত্র। এসব স্থিরচিত্রে দৃশ্যমান রয়েছে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ছাত্রদের ১১ দফার আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকার গঠন, ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, যুদ্ধকালীন নানা ঘটনা, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি।
বিরাজ সেন নিজের কাছে থাকা ছবি ছাড়াও বন্ধুবান্ধব ও সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে ছবি সংগ্রহ করে সুন্দরভাবে বাঁধাই করে সমৃদ্ধ করেছেন ‘সম্প্রীতি চিত্রশালা ৭১’। এই ঘরে যেন ইতিহাস কথা কয়। এখানে আরও স্থান পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী আজম খান, সুজেয় শ্যাম, শিল্পী মান্না দে, ভূপেন হাজারিকা, রাজনীতিক মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে এম ফজলুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, মনসুর আলীসহ বহু জাতীয় নেতা ও গুণীজনের দুর্লভ ছবি।
বিরাজ সেনের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৬ জানুয়ারি। বরদাকান্ত সেন ও সুপ্রভা সেনের চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে তিনি কনিষ্ঠ। তারুণ্যদীপ্ত মানুষটি আক্ষেপ করে বললেন, ‘সীমাহীন স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। প্রত্যাশাও ছিল অনেক। ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবার হত্যা, কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা স্বাধীন দেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে।’
জানতে চাইলে বিরাজ সেন বললেন, ভারতে যাঁদের সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সাংবাদিক সৈয়দ আহমদ ফারুক, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, আ স ম আবদুর রব, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, ইসমত কাদির গামা, আবদুল কুদ্দুস মাখন, ভিপি আখতারুজ্জামান, মোহন লাল সোম, তৌফিক রুমি প্রমুখ। আর শ্রীমঙ্গলের এই বধ্যভূমিতে যেসব শহীদের লাশ পাওয়া গেছে তাঁরা হলেন সমীর সোম, মঈন উদ্দীন, আলতাফ, মুকিত লস্কর, আনিস, সুদর্শন, রানু, খোকা, শহীদ, শম্ভু তাঁতিসহ অনেকে। বললেন, ‘তাঁদের কথা ভুলতে পারি না বলে প্রায় প্রতিদিনই এ বধ্যভূমিতে আসি।’

Comments