রাখাইনে গণকবর, কঙ্কাল বেরিয়ে আসছে হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের খুলি হাড়গোড়



    জয়নাল আবেদীন »
    কক্সবাজারের টেকনাফে লেদা অনিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরে রাখাইন বর্বরতার অনেক তথ্য দেন সাম্প্রতিক সময়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। তাদের মধ্যে ছিলেন উত্তর মংডুর ছুটাগজাবিলের আনোয়ারা বেগমও।
    তিনি বলছিলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা শুরুর প্রথম দিকেই তাদের গ্রামে হামলা করেছিল মিয়ানমারের স্বশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। নারীদের ওপর নিপীড়ন আর পুরুষদের ধরে নিয়ে হত্যার সেই নিষ্ঠুর কাহিনি তিনি বলেছিলেন নিউজ১৯৭১ প্রতিবেদককে।
    সেই ছুটাগজাবিলে এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের কঙ্কাল- মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড়। দুটো গণকবরের সন্ধান মিলেছে গত ১৮ জানুয়ারি। খুলি এবং হাড়গোড় মিলিয়ে দেখা যায়, দুটো গণকবর থেকে পাওয়া গেছে অন্তত ১২ জনের কঙ্কাল।
    রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান ‘অভিযানের’ প্রেক্ষিতে নতুন করে সম্প্রচার শুরু হওয়া স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ‘আর-ভিশন’ ছুটাগজাবিলে গণকবর থেকে কঙ্কাল উদ্ধারের খবর প্রচার করে।
    সেখানে বলা হচ্ছে, গত ১২ থেকে ১৪ অক্টোবর ছুটাগজাবিল এলাকায় অভিযান চালিয়েছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সেই তিনদিনের অভিযানে ওই গ্রামে অন্তত ৩১ জন হতভাগ্য রোহিঙ্গা পুরুষকে প্রাণ হারাতে হয়। সম্ভ্রম হারান অগণিত নারী। সেই থেকে উত্তর মংডুতে চলে একের পর এক ভয়ংকর নৃশংসতা।
    স্থানীয়দের ভাষ্য এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী ছুটাগজাবিলে প্রথম অভিযানের তিন মাস পেরিয়েছে। সেই সময় যেসব রোহিঙ্গারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের একইসঙ্গে মাটিচাপা দিয়েছিল নিষ্ঠুর হামলাকারীরা। সেই রোহিঙ্গাদের কঙ্কালই এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
    Rohingya Konkal_news1971 (1)
    উদ্ধার হওয়া কঙ্কালগুলো একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়নি। ছবিতে দেখা যায়, মুখমণ্ডলের ভেতরে দাঁতগুলো এখনো অক্ষত। রঙে পরিবর্তনও আসেনি। শরীরের অনেকগুলো হাড় আলাদা হয়ে গেলেও মেরুদণ্ড থেকে পাজরের হাড়গুলো অবিচ্ছিন্ন।
    এই দুটো গণকবরের সন্ধান মেলার পরে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা আরও সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তারা বলছেন, গণকবর থেকে মানুষের কঙ্কাল উদ্ধারই প্রমাণ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে কি পরিমাণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তারা বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর গোচরে আনতেও মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
    বিশেষ করে সদ্য সফর করে যাওয়া জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংজি লি-কে এসব কঙ্কালের ছবি দেখাতে চান। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের আক্ষেপ, জাতিসংঘ দূতকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া এলাকাগুলোয় নেওয়া হয়নি। ফলে তিনি নির্যাতনের সত্যিকারের মাত্রাটা বুঝতেও পারেননি।
    আবারও জাতিসংঘের কোনো দূত রাখাইন পরিদর্শনে যেতে চাইলে তাদেরকে উত্তর মংডুর ধ্বংসস্তুপ দেখে যাওয়ার আহ্বান জানান অসহায় রোহিঙ্গারা।
    নিউজ১৯৭১ প্রতিনিধি দল কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে গত মাসে টানা কয়েকদিন ধরে অবস্থান করেছিল। সে সময় রোহিঙ্গারা জানিয়েছিলেন যে, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে ধ্বংসযজ্ঞ দেখানো হয়নি। নামসর্বস্ব কয়েকটি এলাকা থেকে ঘুরিয়ে তাকে বোঝানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর কোনো রকমের নিপীড়ন চলছে না। কখনো হয়নিও! একইভাবে মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংজি লি-কেও বহুদূরে রাখা হয় আক্রান্ত এলাকা থেকে।
    গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তিনটি ফাঁড়িতে হামলা করে দুর্বৃত্তরা। সেই ঘটনার দায় চাপিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হামলা করে স্বশস্ত্র বাহিনী। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সে দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উগ্রপন্থীরাও।
    উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা রশিদ (৫৫), ফকির আহাম্মদ (৫০), মাহাদা খাতুন (৪২), মরিয়ম বিবি (৩৫) নিউজ১৯৭১ডটকম-কে জানিয়েছিলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা নির্মূলের যুদ্ধই শুরু করেছে। তারা সেখানকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রত্যেক নাগরিকের হাতে হাতে তুলে দিয়েছে মরণাস্ত্র। প্রতিরোধে টিকতেই পারছে না নিরস্ত্র বেসামরিক রোহিঙ্গারা।
    যদিও মিয়ানমার সরকার রাখাইনে এ ধরনের পরিস্থিতির কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
    তবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস হামলার ঘটনাবলী উঠে আসে। নাফ নদীর দুই পারে রোহিঙ্গাদের যে নিষ্ঠুর জীবনাখ্যান, সেটিও উঠে আসে বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
    রোহিঙ্গারা আরো জানিয়েছিলেন, সহিংসতার শুরুর প্রথম দিকে একজন বিশেষ প্রতিনিধিকে রাখাইনে পাঠান অং সান সুচি। ওই প্রতিনিধি স্থানীয় প্রশাসনিক বাহিনীকে জানিয়ে যায়, রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে হবে। ওপর থেকে এটিকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ দাবি করা হলেও ভেতরে এর নাম ‘রিজন ক্লিন অপারেশন’। আর, ‘রিজন ক্লিন’ বলতে তারা রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করাই বুঝিয়ে থাকে।
    সেই অপারেশন এখনো চলছে। রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নৃশংসতা আন্তর্জাতিকপর্যায়ে যতই ক্ষোভ ছড়াক, নিজের অবস্থানে অটুট রয়েছেন সুচি। রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান গণহত্যাকে তিনি যতই অস্বীকার করুন না কেন, একের পর এক বেরিয়ে আসা হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের কঙ্কালই উন্মোচন করে দেয় সবকিছু।
     Rohingya Konkal_news1971 (2)Rohingya Konkal_news1971 (3)
    mongsai79@gmail.com

    Comments