আমি কীভাবে ৩৩ পাউন্ড ওজন কমালাম

..একদিন আমার ওজন নিয়ে দেখি, ৮৭ কেজি। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমার ধারণা ছিল, আমার ওজন ৭৭-৭৮ কেজি। আমার বয়স ৫১ কি ৫২, উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। ডাক্তার বলেছেন, আমার ওজন ৬৭ কেজি হলে ঠিক আছে, ৬৫-ও চলবে, ৭০-ও চলতে পারে, কিন্তু তাই বলে ৮৭ কেজি! আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ৭৭ কেজি ওজনের সময়ই আমার ভুঁড়িতে আঙুল দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি তো দেখি জলহস্তী হয়ে যাচ্ছ।’ এখন আরও ১০ কেজি ওজন বৃদ্ধির পর আমাকে দেখলে তিনি কি বলবেন, ‘আনিস, তুমি আর জলহস্তী নেই, তুমি এখন স্থলহস্তী হয়ে গেছ। কী লজ্জা, কী লজ্জা!’
সেদিন ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬। আমি ঠিক করলাম, খাওয়া বন্ধ করে দেব। ওই দিনই নারায়ণগঞ্জ স্কুলে আমার একটা আমন্ত্রণ ছিল। কিশোর আলোর সম্পাদক হিসেবে আমি ছিলাম আমন্ত্রিত। তাই ‘না’ করতে পারলাম না।
স্কুলে দুপুরে খেতে হবে। তারপর অনুষ্ঠান শুরু হবে।
প্রথমে পাতে পড়ল সালাদ, সবজি, একটা আধা কেজি ওজনের মুরগির রান, ছোট মাছ। আড়াই কেজি ওজনের একটা ইলিশ মাছের ঠিক মধ্যখানের পেটি। আমি বলি, দিচ্ছে যখন খাই। যখন খাওয়া শেষ করে এনেছি মুড়িঘন্ট দিয়ে, তখন অকস্মাৎ পাতে এসে পড়ল একটা রুই মাছের পেটি, যার ওজন এক কেজির কম নয়। আমি কাঁদব, না হাসব। স্তব্ধ হয়ে রইলাম। আগে বলবেন না যে রান্নাঘরে আরও আছে। গলা পর্যন্ত খাওয়া উঠে এসেছে, এরপরেও বলে, খেতেই হবে। তারপরেও মুক্তি নেই, এই রসগোল্লা অমুক দোকানের, আর এই দই যে না খেয়েছে, তার মানবজনমই বৃথা।
পড়েছি নারায়ণগঞ্জবাসীর হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। খেলাম। এবং প্রতিজ্ঞা করলাম, আর খাব না। অদ্যই শেষ মধ্যাহ্নভোজ।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখটা আমার মনে আছে। কারণ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরার পথে গাড়িতেই পেলাম সেই দুঃসংবাদটা, আমাদের প্রিয় কবি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক আর নেই। গাড়ি সরাসরি গুলশানে নিয়ে গেলাম।
পরের দিন ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করলাম আমার নো-কার্ব ডায়েট। এটার পরামর্শ কে দিয়েছিল, কীভাবে দিয়েছিল, মনে নেই। তবে ইন্টারনেটে যে ব্যাপক গবেষণা করেছি, তা মনে আছে।
নিয়মটা হলো ভাত, রুটি, আলু, চিনি—শ্বেতসার আছে এমন কিছু খাব না। মাছ, মাংস, টকদই, শাক, সবজি, শসা, ফল, বাদাম প্রচুর পরিমাণে খাব। শাকসবজি তো সব সময়ই ভালো। আর ভালো মাছ। টকদই খেতে হয়, তাহলে অনেক ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও মিনারেল পাওয়া যায়। কমলা, পেয়ারা, পেঁপে, আনারস, দু-চারটা আঙুরও খাওয়া ভালো। কারণ, আপনার ব্রেন মিষ্টি চায়। সরাসরি না খেয়ে প্রাকৃতিক মিষ্টি খেলে মস্তিষ্কও খুশি হলো, আবার চিনি খাওয়ার ক্ষতিও হলো না। আমিষ খাওয়া ভালো। কারণ, আমিষ নিজেকে হজম করতে গিয়ে নিজের ক্যালরি পুড়িয়ে ফেলে। একজন ডাক্তার বলেছেন, চিনি ও লবণ না খেলে পৃথিবীর অর্ধেক রোগ থাকত না।
গত চার মাস আমি ভাত খাইনি। রুটি খাইনি। সব মিলিয়ে চার মাসে চারটার বেশি মিষ্টি খাইনি। কোনো বিস্কুট খাইনি। আইসক্রিম, চকলেট—প্রশ্নই আসে না।
টকদই আর শসা মিশিয়ে জিরা দিয়ে ব্লেন্ড করে খেয়েছি। ওট খেয়েছি।
আমি মাল্টিভিটামিন খেয়েছি। জিংক, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘ডি’ খেয়েছি।
প্রথম সপ্তাহে ওজন কমেছে তিন কেজি। এরপর ওজন কমার হার কমে গেছে। সব মিলিয়ে ১৮ সপ্তাহে আমার ওজন কমেছে ১৫ কেজি। আমি অনিয়মিতভাবে ব্যায়াম করি, স্থির সাইকেল চালাই কুড়ি মিনিট।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ
১. ডায়েটিশিয়ান ও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ডায়েট করবেন না। আমার ডাক্তার ভাবি বলেছেন, নো-কার্ব ডায়েট করতে গিয়ে দুজন মারা গেছে। সত্য-মিথ্যা জানি না।
২. আমার ডায়াবেটিস নেই। ব্লাড প্রেশারের ওষুধ খেতাম। কমিয়ে অর্ধেক করেছি। আরও কমাতে হতে পারে।
৩. মেয়েদের নানা ধরনের অপুষ্টি ও ভিটামিন-মিনারেলের অভাব থাকে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া তাঁদের ডায়েট করা উচিত নয়।
৫. প্রচুর পানি, দুধ-চিনি ছাড়া চা খাই। কফিও খাই।
৬. শসা, টকদই, বাদাম, বীজ—এক ঘণ্টা পরপর কিছু না কিছু খাই। ফল খাই। না খেয়ে থাকি না। তবে ভাত-রুটি-বিস্কুট-কেক-মুড়ি-আইসক্রিম-মিষ্টি খাই না।
আমি বলছি না যে আমার ডায়েট আপনারা অনুসরণ করুন। তবে আমি বলতে পারি, যাঁদের ওজন বেশি, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা করতে পারেন। বেশি ওজন বহু রোগের কারণ। আর আমরা যেহেতু শারীরিক শ্রম করি না, হাঁটি না, নিজের কাজ নিজে করি না, আমাদের জন্য বাড়তি ওজন বিপজ্জনক।
কিন্তু আমি ওজন কমানোর সূত্র বলার জন্য এই লেখা লিখছি না।
আরেকটা কথা বলার জন্য এই লেখা লিখছি। জানুয়ারি মাসে আমি আরেকটা কাজ করেছি। তা হলো ফেসবুকে না যাওয়া। আমাকে উপন্যাস লিখতে হবে। কিছুতেই লিখতে পারি না। বাইরে কত জরুরি কাজ, কত উত্তেজনাকর বিষয়। অমুক খেলোয়াড়কে এয়ারপোর্টে আনসার অপমান করেছে, অমুক টিচারকে রাস্তার বখাটেরা ঝাড়ি দিয়েছে, ট্রাম্প পাগলামো করছেন—সব বিষয়ই তো লেখার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মনোযোগ-অপহারী। ফেসবুক এই সব বিষয়ে আমাকে আপডেট রাখছে। আমি সেসব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। স্ট্যাটাস দিচ্ছি। তারপর দেখছি, আর কে কী বলছেন। উপন্যাস লিখব কখন?
তখন আমার মনে হলো, ভাত ছাড়া আমি তিন মাস ধরে আছি, তাহলে ফেসবুক ছাড়া আমি কেন চলতে পারব না। আমি ফেসবুকে ঢোকা বন্ধ করে দিলাম।
ওমা! কী শান্তি! দুটো উপন্যাস লিখে ফেললাম। ১. ‘প্রিয় এই পৃথিবী ছেড়ে’ (প্রথমা প্রকাশন)। বাংলাদেশের একটা মেয়ে মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে, একমুখী যাত্রা, আর ফিরবে না। এটা নিয়ে কত পড়াশোনা করলাম, আর লিখেও ফেললাম। ২. ‘এক লাখ লাইক’ (সময় প্রকাশনী)। ফেসবুককে সমাজবদলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না, এই হলো বিষয়।
যা হোক, ফেসবুক বন্ধ করায় আমার শুধু দুটো উপন্যাস লেখা সম্পন্ন হলো, তা-ই নয়, এর ফাঁকে আমি অন্তত ১০টা বইও পড়ে ফেললাম। এখন ব্যায়াম করারও সময় পাই। ‘গল্পগুচ্ছ’ বের করে গল্প পড়লাম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প পড়লাম, শংকরের ‘চৌরঙ্গী’ অর্ধেক শেষ, কুন্ডেরার ‘আইডেন্টি’ পড়া চলছে, ‘দেশ’ পত্রিকার উপন্যাসগুলো পড়ছি। হাতে কত সময়, কত সময়!
সবচেয়ে বড় কথা, মনে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। উদ্বেগ নেই, উত্তেজনা নেই। বাইরের পৃথিবীর কোলাহল আমার নিরুপদ্রব ঘরের দরজা-জানালা ভেদ করে ঢুকছে না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, পাশের ফ্ল্যাটের দেয়ালের ফুটোতে দুটো টিয়া পাখির বাসা। একে অপরকে ঠোঁটে করে খাওয়াচ্ছে। আহ্‌, পৃথিবী এত সুন্দর, ফেসবুক বন্ধ করার আগে জানা ছিল না।
আমার তিনজন অ্যাডমিন আছেন, যাঁরা আমার ফেসবুকের পেজটা চালান। ওঁরা চালাবেন। আমি খুলেও দেখব না কী হচ্ছে না হচ্ছে।
এত শান্তি আমার জীবনে গত ১০টা বছর আর আসেনি।
mongsai79@gmail.com

Comments