দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা (প্রথম পর্ব)

শুধু এশিয়া নয়, সারাবিশ্বে শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া নেতৃস্থানীয়। সেরা শিক্ষাব্যবস্থার র‍্যাংকিংগুলোতে সেরা পাঁচে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান এখন নিয়মিত ব্যাপার। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, কিংবা সাহিত্য সবক্ষেত্রে কোরিয়ানদের অগ্রগতি ছিলো অনেকটাই মিরাকল। মিরাকলের পিছনে যার বিশেষ ভূমিকা তা হলো তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বাংলা টেলিগ্রাফে নিয়মিত লিখছেন রিদওয়ানুল মসরুর। আজ প্রকাশিত হলো তার প্রথম পর্ব।
দক্ষিণ কোরিয়ার কথা মনে এলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কে-ড্রামার সেট, কানে ভেসে আসে কে-পপ এর সুর – কিংবা হয়ত অন্য কিছু। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া কেবল এই কে-পপ আর কে-ড্রামার জন্যই সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত না; বরং তার হাতের আস্তিনে লুকিয়ে আছে আরো অনেক অনেক বিস্ময়কর বাস্তবতার খোঁজ। ষাটের দশকের অন্যতম গরীব দেশ থেকে আজকের অন্যতম ধনী ও উচ্চশিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির দেশ হয়ে ওঠার পেছনে লুকিয়ে আছে দক্ষিণ কোরিয়ার দারুণ শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিসীম অবদান। কিভাবে ষাটের দশকের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা আর মৃতপ্রায় অর্থনীতি আজ বিশ্বের সেরা হয়ে উঠেছে – সেই গল্প যেন রূপকথাকেও হার মানাবে।কোরিয়ান স্কুলের চিত্র
কোরিয়ান স্কুলের চিত্র
কোরিয়ান স্কুলের চিত্র
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত – উন্নত সব দেশ, শিক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মাল্টিল্যাটেরাল প্রতিষ্ঠানসমুহ (যেমন – ওয়ার্ল্ড ব্যাংক) সবাই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশংসায় যখন পঞ্চমুখ, তখনও থেমে নেই কোরিয়ানরা। প্রতিনিয়ত নানা আবিষ্কার আর অর্জনে নিজেদের মুকুটে প্রশংসার পালক যোগ করেই চলেছে। কথায় আছে – গেয়ো যোগী ভিখ পায় না – কোরিয়াও যতটা না সমাদৃত এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে, তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি সমাদৃত পশ্চিমা বিশ্বে। সাম্প্রতিক সময়ে এক কনফারেন্সের সুবাদে বেশ খানিকক্ষণ আলাপ হয়েছিলো কানাডার অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল পলিসি স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর লিনেত শাল্টজ এঁর সাথে। তিনি বলছিলেন –‘দক্ষিণ কোরিয়ার পূর্ববর্তী শিক্ষা নীতির রিফর্ম বা পরিবর্তনগুলো আজ যখন আমরা বিশ্লেষণ করি, মনে হয় সব যেন কোন এক মিরাকলে খাপে খাপে মিলে গেছে’। কিন্তু বাস্তব জীবনের চলমান গতিময়তায় চার-পাঁচ দশক ধরে নিয়মিত হারে প্রয়োজনমাফিক মিরাকল ঘটে যাওয়া অসম্ভব। বরং এই মিরাকলই প্রমাণ করে, জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষা সংক্রান্ত পরিকল্পনা ও সেই পরিকল্পনার পরিশ্রমসাধ্য বাস্তবায়নে কতটা দূরদর্শী ও নিবেদিতপ্রাণ ছিলো কোরিয়ানরা।
স্কুলগুলোতে রয়েছে খেলাধূলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা
স্কুলগুলোতে রয়েছে খেলাধূলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা
স্কুলগুলোতে রয়েছে খেলাধূলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা
ওইসিডি (OECD) এর তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পঠন দক্ষতা, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে দক্ষিণ কোরিয়া। পিসা (প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এ্যাসেসমেন্ট) পরীক্ষা মূলত বিশ্বব্যাপী ও,ই,সি,ডি এর তালিকাভুক্ত ধনীদেশগুলোর ১৫ বছর বয়সীদের পঠন দক্ষতা, বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে পরীক্ষা। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে মেধার সাথে সাথে রয়েছে শিক্ষা খাতের সকলের অসম্ভব পরিশ্রম। একইসাথে দারুণ ভূমিকা রয়েছে প্রশিক্ষিত ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকগণের। অতি ভঙ্গুর অবস্থা থেকে কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার এই শীর্ষে আরোহণ এর ক্ষেত্রে অসম্ভব ত্যাগ স্বীকার করেছেন একসময়ের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ – সে গল্প করবো আরেকদিন।
যা হোক, কোরিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থা কে চারটি স্তরে ভাবতে পারি আমরা। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক, মিডিল স্কুল (নিম্নমাধ্যমিক বলা যেতে পারে), হাই-স্কুল (উচ্চ মাধ্যমিক বলা যেতে পারে) এবং উচ্চ শিক্ষা। বয়সকাঠামোর সাপেক্ষে শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক কাঠামো নিচে তুলে ধরা হলো –
Korean Education system
Korean Education system
কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার চার স্তর
প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে এক বছরের সরকার প্রদত্ত কিন্ডারগার্টেন এ পড়াশোনার বিধান রয়েছে। তবে অনেক বাবা-মা সন্তান কে নার্সারি স্কুল সমূহে ভর্তি করান যেগুলোর বেশিরভাগই প্রাইভেট এবং ডে-কেয়ার ধরণের।
প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ফ্রি ও বাধ্যতামূলক। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে, সাধারণত শ্রেণি শিক্ষক সকল বিষয় পড়িয়ে থাকেন; তবে বিদেশী ভাষা (ইংরেজি) ও শারীরিক শিক্ষার জন্য আলাদা শিক্ষক থাকে। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকতা কোরিয়াতে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় এবং কেবলমাত্র যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণরাই সেই সুযোগ পেয়ে থাকেন। যাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান, তাঁদের ‘প্রাথমিক শিক্ষা’ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ পর্যায়ে ডিগ্রি (ব্যাচেলর অব এডুকেশন/প্রাইমারি এডুকেশন) আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন।
মিডল স্কুল কে কোরিয়ানে ‘জোং হাক্কিয়ো’ বলা হয়ে থাকে। মিডল স্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা করা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক ও ফ্রি। হাইস্কুলকে কোরিয়ানে ‘খোদোং হাক্কিয়ো’ নামে বলা হয় যা বাধ্যতামূলকও না, ফ্রি ও না। তবে সেই আশির দশক থেকেই ৯৯ শতাংশ মিডল স্কুল গ্রাজুয়েট হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে থাকে। হাইস্কুল সাধারণত তিন ধারায় বিভক্ত – সাধারণ বা একাডেমিক, ভোকেশনাল এবং বিশেষায়িত। এই বিশেষায়িত বিদ্যালয় সাধারণত বিদেশি ভাষা, বিশেষ কলা এবং বিজ্ঞান এই তিন উপধারায় বিভক্ত।
কোরিয়ার উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় পঁচাশি ভাগই বেসরকারি। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে বেশ কয়েক দলে ভাগ করা যায় – কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় (সার্বজনীন সারাবিশ্বে), শিল্প বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, জুনিয়র কলেজ, গণমাধ্যম ও সম্প্রচার (ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে – ব্রডকাস্ট ও করোসপণ্ডেস) বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়, টেকনিক্যাল কলেজ। দেশের সর্বোৎকৃষ্ট তিনটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কাই/SKY – Seoul National UniversityKorea University এবং Yonsei University) বিশ্ব পর্যায়ে গবেষণা, পড়াশোনার মান ও সৃজনশীলতার দিক দিয়ে দারুণ সুনাম অর্জন করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা এর দ্বিতীয় পর্ব – কোরিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস ও ক্রমপরিবর্তন বিষয়ে – বাংলা টেলিগ্রাফে প্রকাশ হবে ৩১ শে জানুয়ারি ২০১৭।    
001 copy
mongsai79@gmail.com

Comments