বিশ্বাসের ভাইরাস-৩


গল্পটির সাথে পানছড়ির "আমলকি বাবার"মিল খুজে পাওয়া গেলে, লেখককে দায়ী করা যাবেনা |

ছবি: আমলকি বাবা ঔরফে গুরুহানা

দারিদ্রের চরম কষাঘাতে জর্জরিত মধ্যবয়ষ্ক জুমিয়া “লেত্যোবাপ” । দুই ছেলে লেত্যো, থুঙ্গো আর বউ মিনতিদেবীকে নিয়ে সংসার লেত্যোবাপের । ভালো নাম কিশোর কুমার হলেও, বড় ছেলের নামের সাথে পরিচিত হতে হতে, এখন সেই নামটি প্রায় মুছে যেতে বসেছে । অবশ্য আরো একটি নাম আছে কিশোর কুমারের । কিশোর বয়সে গরু চড়াতে গিয়ে, গরুর গুঁতো খেয়ে একটি চোখ হারাতে হয়েছিল বলে, আরও একটি ডাকনাম পাওনা হয়ে গিয়েছিল, “গুরুহানা” । যদিও সেই নামটি কেউ সামনা সামনি ডাকে না, কিন্তু আড়ালে-আবডালে, মানুষের মুখে মুখে “গুরুহানা” নামটিই বেশি ফেরে । লেত্যোবাপ পেশায় জুমিয়া আর পাশাপাশি বৌদ্যগিরি করার কারনে, বড়রা ভয়ে সামনা সামনি ঐ নামটি কেউ উচ্চারন করেনা, যদি তন্ত্র-মন্ত্র করে !
বড়রা ভয় পেলে কি হবে, ছোটছোট ছেলেমেয়েরা কিন্তু সুযোগ পেলেই ঝোপের আড়াল-গাছের আড়াল থেকে “গুরুহানা” ডাক দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগটি ছাড়ে না । এভাবে দিন-মাস-বছর ঘুরে । জুমে ধান, কলা, তিল, মারফা ফলিয়ে যা আয় হয়, আর কারোর অসুখ-বিসুখে বৈদ্যগিরি করে যা আয় হয় তাতে কোনরকমে দিন চলে যায়, লেত্যোবাপ আর তার পরিবারের ।
বছর চার-পাঁচেক আগে পাশের গ্রামে একটি বন বিহার স্থাপিত হয়েছে । বিহারটির কল্যানে, এলাকার বহু মানুষের পাশাপাশি লেত্যোবাপও আস্তে আস্তে ধর্মাচার পালনের দিকে ঝুকেছে । ভান্তেদের দেশনা শুনে আর ধর্মীয় বিভিন্ন বই পড়ে, চিন্তা জগতে আমূল পরিবর্তন ঘটে লেত্যোবাপের । কিন্তু এতে, বৈদ্যগিরির পসার অনেকটা কমে যাওয়ায়, তন্ত্র-মন্ত্রের পাশাপাশি যাগ-যজ্ঞের পরিবর্তে পঞ্চশীল পালন-অষ্টশীল পালন এসব যুক্ত করতে হয়েছে লেত্যোবাপকে । তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার সুবাধে, আর বিহারটিতে যাতায়াতের সুবাধে অনেক ধর্মীয় বই পড়ার সুযোগ হয় লেত্যোবাপের । অর্থনৈতিক টানাপোড়ন, আর জুমিয়া জীবনের নিত্য সাংসারিক অভাবের কারনে, ইচ্ছে থাকা সত্বেও প্রতিদিন বিহারে যাওয়া হয়না লেত্যোবাপের । তাই, বাড়িতে বসেই ধর্মাচার পালন করতে থাকে সে । প্রতিদিন বুদ্ধমুর্তির সামনে সকাল-বিকেল প্রার্থণা আর প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে অষ্টশীল পালন করতে থাকে লেত্যোবাপ । কাজের ফাঁকে সময় পেলেই সে ছুটে যায়, জুমের ছোট্ট জুমঘরটিতে । সেখানে সে একা একা ধ্যান করে, আর জীবন-জগতের রহস্যের সন্ধান খুজতে থাকে । এভাবে ধ্যান করতে করতে, কোনদিন গভীর রাতে বাড়ি ফেরে আবার কখনও বা ভোর হয় !
ধ্যানের মাধ্যমে জীবন-জগতের রহস্য অনুসন্ধান, পরিবারের ভরণপোষণের ভাবনা আর কারোর অসুখ-বিসুখে তন্ত্র-মন্ত্র, তরিকা আর ঔষধ বাতলে দিয়েই কেটে যাচ্ছিল, লেত্যোবাপের দিনপঞ্জি । লেত্যোবাপের এই ধ্যান আর তন্ত্র-মন্ত্রের মাধ্যমে রোগাক্রান্ত মানুষকে আরোগ্য লাভ করিয়ে দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পরতে থাকে ধীরে ধীরে, মানুষের মুখে মুখে । পসার আর প্রচার দুটোই বাড়তে থাকে সমানে । কেউ আসে দীর্ঘদিনের হাপানি থেকে আরোগ্য লাভের আশায়, কেউ আসে ডায়বেটিস থেকে মুক্তির আশায় আর কেউবা আসে প্যারালাইসিস থেকে মুক্তির আশায় । কিন্তু, লেত্যোবাপ ফিরিয়ে দেন না কাউকেই । তিনি সবার চিকিৎসা করেন, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই নেন না ! ভক্ত আর গুণগ্রাহীরা খুশি হয়ে যা দান করেন, তাতেই তিনি খুশি । তিনি কারোর কাছে কিছু চান না, কেউ কোন কিছু দিলে, নিজের ভোগের জন্যও রাখেন না !
দিকে দিকে ছড়িয়ে পরতে থাকে, লেত্যোবাপের সুনাম কিংবা দূর্নাম । লেত্যোবাপ নিজেকে অর্হৎ, মার্গফললাভী, সর্ব রোগের অলৌকিক মুক্তিদাতা হিসেবে দাবী করতে থাকেন । এমনকি, বন ভন্তের আত্মা তার মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে বলেও দাবী করতে থাকেন । তিনি ভক্তদের জন্য কোনসময় আমলকি, কোন সময় চকলেট, কোন সময় প্রাণ ফ্রুটো ম্যাংগো জুস, কোন সময় মোয়া ইত্যাদি দিয়ে ভক্তদের জন্য বাতলে দিতে থাকেন, সর্বরোগের ঔষধ ! ভক্তরা মুগ্ধ হয়ে ওঠে গুণকীর্তনে । দীর্ঘদিনের বাতের ব্যতা থেকে মুক্ত হয়ে এলজিইডির প্রকৌশলী সাহেব দান করেন জেনারেটর, বড়বাজারের বড় ব্যবসায়ী দান করেন গাড়ি । সেসব দানীয় সামগ্রীর গায়ে লেখা থাকে, কে দিয়েছে কোনটি । আর সেসব দেখে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীদের মধ্যে তর্ক চলতে থাকে । মাঠ-ঘাট, চায়ের দোকান পেরিয়ে অনলাইনেও ঝড় ওঠে ! চলতে থাকে তর্ক-বিতর্ক । প্রচার বাড়তে থাকে । ভক্তদের দল ছুটতে থাকে রোগমুক্তির আশায় । কেউ ছুটে মোমবাতি হাতে, কেউ ছুটে আগরবাতি হাতে নিয়ে আর কেউবা বিভিন্ন দানের সামগ্রী হাতে নিয়ে । এককথা থেকে দুই কথা হয়ে যায় । সবাই বলাবলি করে প্যারালাইসিসের রোগীকে এক ছোয়াতে ভাল করে দেওয়ার গল্প, কেউ বলে হাঁপানির রোগীটাকে ছোয়ানো পানিতে মূহুর্তে মুক্তি দেওয়ার গল্প ! কিন্তু কেউ দেখেনি, সবাই বলে “শুনেছি” ! লেত্যোবাপকে এখন আর লেত্যোবাপ বলা যায়না । বলতে হয়, সাধক ! সাধকের এমনই গুণ যে, পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালিরাও ভীড় জমায় সাধকের আস্তানায় রোগ মুক্তির আশায় ।সাধকের আস্তানার আলাদা আলাদা স্থানের আলাদা আলাদা নামকরন হয় । থাকার জায়গার নাম হয় “জ্ঞানঘর”, ধ্যান করার নির্ধারিত স্থানের নাম হয় “দ্বিতীয় বুদ্ধগয়া”, আবার কোনটার নাম “দেবতা গুহা” ।
এভাবে দিন যায়-সপ্তাহ যায় । পূন্যার্থী, ভক্ত আর গুণমুগ্ধদের পদচারনায় মুখরিত হতে থাকে, সাধকের ঢেড়া । ভক্ত আর পূন্যার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দানীয় সামগ্রী আর দান বাক্সটিও ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে । দানীয় সামগ্রীগুলি সাধকের নিজের ব্যবহারের কথা না থাকলেও, কি এক অজানা কারনে অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল হতে থাকে লেত্যোবাপের পরিবার ও তার আত্মিয়-স্বজনদের ! চারদিকে সাধকের নামের ভারে বিভিন্ন বিহারের মহাস্থবীর, মহাথের আর মার্গফললাভী, অনুবুদ্ধখ্যাত ভিক্ষুরাও বিবৃতি দিতে থাকেন, “ধ্যান করলে অবশ্যই ফল পাওয়া যায় । লেত্যোবাপও ধ্যান করে ফল পেয়েছে । কিন্তু, এভাবে নিজের কথা বলে বেড়ানোটা ঠিক নয়”।
মাইনী, চেঙ্গীর জল বহুদূর গড়ায় । অতিবাহিত হতে থাকে মাসের পর মাস । পসার কমতে থাকে লেত্যোবাপ তথা সাধকের ! সাময়িক ফল পেয়েছিল বলে যারা দাবী করেছিল, তারাও বিমূখ হতে থাকে ধীরে ধীরে । কমতে থাকে ভক্ত ও আরোগ্যলাভ প্রার্থীদের সংখ্যাও ! বছর ঘুরতেই দেখা গেল, সাধকের গুণকীর্তনে মুগ্ধদের স্মৃতি থেকেও মুছে গেল, লেত্যোবাপের নাম । আরোগ্যলাভ প্রার্থীদের সংখ্যাও কমে গেল প্রায় শূন্যের কোটায় । কিন্তু, এর মধ্যে যা হওয়ার হয়েছে । লেত্যোবাপকে এখন আর সাধক সেজে বসে থাকতে হয়না । করতে হয়না জুমেও কাজ । লেত্যোবাপের বাড়ি এখন পাকা হয়েছে । ব্যাঙ্কে জমা হয়েছে অর্ধকোটি টাকা । ছোট ভাই কিনেছে দুইটা ট্রাক্টর । একমাত্র শ্যালক গঞ্জবাজারে সাজিয়েছে চাউলের দোকান ।
mongsai79@gmail.com

Comments