বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে সক্রিয় রোহিঙ্গাদের আলোচিত বিদ্রোহী সংগঠন আল অ্যাকিন। যে গোষ্ঠীটি মিয়ানমারের তিনটি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বিজিপি’র অন্তত ৯ সদস্যকে হত্যা এবং বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটের ঘটনার দায় স্বীকার করে। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাতে মিয়ানারের রাখাইনের মংডুতে হামলা এ ঘটনা নিয়ে সংগঠনের প্রধান আবু আম্মর জুনুনী ফেসবুকে বেশ কয়েকটি ভিডিও বার্তা পাঠান। সশস্ত্র পাহারারত অবস্থায় এ সব ভিডিও বার্তায় তিনি রোহিঙ্গাদের অধিকারের জন্য তাদের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার অনুরোধ জানান।
তবে সীমান্তে এ গোষ্ঠীর সক্রিয় কর্মকাণ্ড বন্ধের জন্য বাড়তি নজরদারি বাড়ানো উচিৎ বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের ভাষ্য এখুনি সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয় আসতে পারে।
মিয়ানমারের আরাকানে হামলার পর পর বেশ কিছুদিন ফেসবুকে সক্রিয় ছিল আল অ্যাকিন। এরপর অনেকটা পর্দার আড়ালে চলে যায় সংগঠনের কর্মকর্তারা। আল-অ্যাকিনের সদস্যরা অনেকটা আড়ালে চলে গেলেও আরো একটি বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে এমনটি ধারণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ও সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের।
মিয়ানমারের গওজিবিল গ্রামের সাবেক মেম্বার হামিদ হোসেন পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আল-অ্যাকিন সদস্যরা বেশ সক্রিয় রয়েছে, কৌশলের কারণে এখন আড়ালে থাকলেও সময়মতো তারা আবার জ্বলে উঠবে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র লড়াই করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে ২০১২ সালের পর থেকে আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়। নারীদের ধর্ষণ করা, রোহিঙ্গাদের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে না দেওয়া, ধরে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করা ছিল সরকারি বাহিনীর নিয়মিত কাজ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে রোহিঙ্গারা আল অ্যাকিন গঠন করে।
তিনি আরো জানান আরএসও, আরএনও, এআরআইএফ নামের রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠনগুলো এক সময় সক্রিয় থাকলেও এদের অবস্থান বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে। আরাকানের অভ্যন্তরে এদের কোনো জনসমর্থন তেমন ছিল না। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল আল-অ্যাকিন। এ সংগঠনটি আরাকানের অভ্যন্তরে পূর্ণ সমর্থন আদায় করতে পেরেছিল।
এদিকে গত ৯ ডিসেম্বর সোমবার রাতে কক্সবাজারের কুতুপালং ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা তুমব্রু গহিন অরণ্যে অভিযান চালিয়ে অন্ত্র উদ্ধার করা হয়। রাত ১০ টার দিকে কুতুপালং এলাকা থেকে একটি পিস্তল ও একটি ওয়ান স্যুটার গান এবং ২৬ রাউন্ড গুলিসহ ৩ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী খাইরুল আমিন (বড়), মাস্টার আবুল কালাম আজাদ ও মোহাম্মদ হাসান আহমদকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। এক পর্যায়ে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু পাহাড়ি এলাকার একটি গর্ত হতে দুটি ড্রামের ভিতর হতে আনসারের লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া উদ্ধার করার হয় তাদের ব্যবহৃত তিনটি দেশীয় তৈরি বন্দুক।
স্থানীয়দের ধারণা আটকেরা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আল অ্যাকিনের সক্রিয় কর্মী। তবে র্যা ব-৭ এর কক্সবাজার ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার লে. কমান্ডার আশেকুর রহমান জানান, আটক তিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আল-অ্যাকিনের সদস্য কি না তা এখনো পরিষ্কার হয় নি। তবে এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে।
আটকদের বুধবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় সোর্পদ করা হয়েছে বলে কোম্পানি কমান্ডার জানান। মামলা রুজুর প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আনসারের লুণ্ঠিত উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গুলি টেকনাফ মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক ও আনসার অস্ত্র লুট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শেখ আশরাফুজ্জামান বলেন, লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার হওয়ায় মামলায় নতুনমাত্রা যোগ হয়েছে। এখন মামলাটির তদন্ত গতি বৃদ্ধি পাবে এবং ঘটনার প্রকৃত হোতাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে।
এদিকে আটক এ তিনজন রোহিঙ্গা আল-অ্যাকিনের অন্যতম সদস্য বলে মনে করেন সচেতন মহল। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, টেকনাফের আনসার ক্যাম্প ও মিয়ানমারের বিজিপি স্থাপনার ঘটনাটির একটি যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে হয়। এ দুটি জঙ্গি হামলা একই সূত্রে গাঁথা। যা আন্তর্জাতিক জঙ্গি হামলারই অংশ বলে মনে হয়। সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা আধুনিকায়ন ও জোরদার করা ছাড়া এ ধরনের আরো হামলা আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এ সংগঠনের সদস্যরাই ২০১৬ সালের ১৩ মে ভোর ২ টার দিকে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে হামলা চালায়। ওই সময় এ ঘটনায় আটক নুরুল আবছার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন। সেখানে উল্লেখ করেন আরএসও নেতা পাকিস্তানি নাগরিক ওমর ফারুকের নেতৃত্বে এ হামলা হয়েছিল এবং লুণ্ঠিত অস্ত্রগুলো মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয় বলেও উল্লেখ করে নুরুল আবছার।
সীমান্তে এদের সক্রিয়তার ব্যাপারে সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নে র্যা ব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের এক ইঞ্চি ভূখণ্ড ও বিদেশি কিংবা দেশীয় সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। জঙ্গি তৎপরতা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করছে সরকার।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার বিষয়টি বেশ পুরনো। যতবার সেখানে নির্যাতন হয়েছে ততবারই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বেড়েছে। বিশেষ করে ৬৩ কি.মি নদী সীমান্ত দিয়ে কোনো না কোনো পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটছে।
এখানে গড়ে ওঠেনি আধুনিক সীমান্ত ব্যবস্থা। ফলে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ থামানো যায়নি। সাম্প্রতিক মিয়ানমারের ঘটনায় প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় মিযানমার সরকারকে জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার কক্সবাজার অফিস প্রধান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার হিসেব মতে এ পর্যন্ত ৪৩ হাজার রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশু সাম্প্রতিক ঘটনায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এরা আবার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আসা যাওয়া থাকায় সঠিক সংখ্যা ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মিয়ানমারে শুমারি চলা কালে নাড়ির টানে অনেকে আবার দেশে ফিরেও যায়। রোহিঙ্গা সমস্যটি একটি আর্ন্তজাতিক সমস্যা হিসেবে মনে করে তিনি বলেন, পৃথিবীর শক্তিশালী রাস্ট্রগুলোকে এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা উচিৎ।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অধাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, সীমান্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা আধুনিকায়ন ও জোরদার করা ভবিষ্যতে পরিকল্পিত হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
Comments
Post a Comment
Thanks for you comment