নারীরা যৌতুকের শিকার হচ্ছেনই

অলংকরণ: তুলিঅলংকরণ: তুলি
যৌতুকের কারণে নির্যাতন, হত্যা, আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ ধরনের ঘটনায় মামলা কম হয়। মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার যৌতুক। প্রতিরোধে দরকার আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সামাজিক আন্দোলন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, যৌতুককে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে ১৭৩ জন নারী খুন হয়েছেন। নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬২টি। আর গত ৫ বছরে এ সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। হত্যার শিকার হয়েছেন ১ হাজার ১৫১ জন নারী। ১৪টি দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এ হিসাব রাখে সংগঠনটি।
মা-বাবা আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন সুখী (২৪)। কিন্তু সুখীর কপালে সুখ তো জোটেইনি; বরং শ্বশুরবাড়িতে বর্বর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বিয়ের ১২ বছরের মাথায় যৌতুক না পেয়ে স্বামী ও তাঁর স্বজনেরা মিলে টেস্টার দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সুখীর ডান চোখটি একেবারে উপড়ে ফেলেন। বাঁ চোখেও ছিল মারাত্মক আঘাত। ঘটনাটি ২০১৫ সালে সাভারের জিঞ্জিরায় ঘটেছে। 
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে যৌতুক নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে; যা বিয়ের আগে থেকে শুরু হয়ে চলতে থাকে। যৌতুকের দাবি মেটাতে গিয়ে কনের পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। আবার এ দাবি মেটাতে না পারলেই নেমে আসে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের খড়্গ। 
যৌতুকের কারণে অনেক নারীকেই হত্যার শিকার হতে হচ্ছে। আবার মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলেও অনেকে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। ২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ৯ জন নারী আত্মহত্যা করেন। ২০১৫ সালে আত্মহত্যাকারী নারীর সংখ্যা ছিল ১৮। হিসাবটি বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন বলছেন, মানুষের মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে; যৌতুক এখন সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদ ও সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা এর বড় কারণ। যৌতুকরোধে সচেতনতা ও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মত দেন এই শিক্ষক।
অর্থনৈতিক কারণে যৌতুক বন্ধ হচ্ছে না বলে মনে করেন নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির পরিচালক আবুল হোসেন। তিনি মনে করেন, সমাজে এখনও মেয়েপক্ষকে মনে করা হয় আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের উৎস। সমাজে যৌতুকপ্রথা বন্ধ করতে দরকার সবার সচেতনতা।
বিয়ের ৫ বছর পরে যৌতুক দিতে রাজি নন পাবনার শম্পা খাতুন (২৫)। এ কারণে বেঁচে থাকার অধিকারই হারিয়ে ফেলেন তিনি। যৌতুক না পেয়ে স্বামী ও তাঁর স্বজনেরা শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন শম্পাকে। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে প্রায়ই তাঁকে মারধর করতেন স্বামী। ঘটনাটি ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির। 
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা কম হচ্ছে। আত্মহত্যার ঘটনার ক্ষেত্রেও তা-ই। আটটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সংস্থাটি এ তথ্য পেয়েছে। 
এ বিষয়ে আইনজীবীরা বলছেন, নারীরা যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হলেও সংসার করার জন্য আইনের আশ্রয় নেন না। পাশাপাশি, আইনি পরিবেশ নারীবান্ধব না হওয়ায় কম যাচ্ছেন। তা ছাড়া, অপরাধীরা সব সময়ই প্রভাবশালী থাকে, তাদের বিরুদ্ধে বিচার পাওয়ার নজির কম। বিচার বিভাগে দীর্ঘসূত্রতা আর ভোগান্তির কারণেও অনেকের অনীহা। 
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী মনে করেন, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও দ্রুত বিচারের জন্য দেশের বিচার বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসনকে আরও প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে।
সালমা আলী বলেন, আইনজীবীদের নারী নির্যাতন মামলা করার সময় মনে রাখতে হবে, যৌন, মানসিকসহ বিভিন্ন নির্যাতনের আলাদা আলাদা আইন আছে। ফলে যেকোনো নির্যাতনেই যেন যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা না হয়। এতে আসামি খালাস পেয়ে যান ও তাঁদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে।
mongsai79@gmail.com

Comments