নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন তিন বছরে হেফাজতে মৃত্যু ২০৫, মামলা হাতে গোনা

তিন বছরে হেফাজতে মৃত্যু ২০৫, মামলা হাতে গোনানির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ পাস হওয়ার পর গত তিন বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছেন ২০৫ জন। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। তারপরও প্রায় অব্যবহৃত এই আইন বাতিলের দাবি তুলেছে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আইনটির বিষয়ে পুলিশের দাবি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এখন কী করা যায়, সেটা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন খুব জরুরি একটি আইন। হেফাজতে আসামিদের কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে সে সম্পর্কে হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে, তারপরও চিত্রটা এমন। এ অবস্থায় আইনটি সংশোধন বা প্রত্যাহারের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।’
এ আইনে এই পর্যন্ত কতটি মামলা, বিচার বা সাজা হয়েছে, সে বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বেসরকারি মানবাধিকার ও আইন সহায়তাদানকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), অধিকার ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) কাছে খোঁজ নিলে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তারা হত্যার ঘটনায় চারটি মামলার খবর দিতে পেরেছে। সব কটিই বিচারাধীন।
আসক বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য ও নিজস্ব অনুসন্ধানে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ২০৫ জন নিহত হওয়ার তথ্য পেয়েছে। এ সময়ে অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আসকের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ ভয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করে না। তিনি বলেন, গত বছর আদাবরে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। প্রথমে অভিযোগ দিলেও পরে ওই ছাত্রী আপস করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করার পর পুলিশ উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহনূর র্যা ব হেফাজতে মারা যাওয়ার পর থানা মামলা নেয়নি। আদালত অভিযোগকে এজাহার হিসেবে বিবেচনা করার নির্দেশ দেওয়ার পর ওই বিচারককেই ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে বদলি করে দেওয়া হয়।
আসক বলছে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন একটি রক্ষাকবচ। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই আইন সম্পর্কে মানুষকে জানাতে চায় না।
এই আইনে ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বলতে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা হলো সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু, অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গ্রেপ্তারের সময় কারও মৃত্যু, কোনো মামলায় সাক্ষী হোক বা না হোক জিজ্ঞাসাবাদের সময় মৃত্যু। আর ‘নির্যাতন’ বলতে বোঝানো হয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকে। সরকারি কর্মকর্তা বলতে প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক যেকোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলতে বোঝানো হয়েছে পুলিশ, র্যা ব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি, শুল্ক, অভিবাসন ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার-ভিডিপি, কোস্টগার্ড, সশস্ত্র বাহিনীসহ আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী সরকারি কোনো সংস্থা।
গত বছরের ১০ নভেম্বর ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় (৫৪ ধারা) গ্রেপ্তার ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) প্রয়োগ নিয়ে আপিল বিভাগ কিছু নির্দেশনা দেন। ওই নির্দেশনার একটিতে বলা হয়েছে, আটক ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে মেডিকেল প্রতিবেদন পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিচারিক বিভাগ পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এতে অভিযোগ জানানো ও বিচার পাওয়ার সুযোগ বেড়েছে।
কিন্তু পুলিশ মনে করছে, এর ফলে তদন্ত করার ক্ষেত্রে তারা ‘সীমাহীন’ সমস্যায় পড়ছে। গত ২৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিলের দাবি জানানোর সময় এই সমস্যার কথা বলা হয়।
অভিযোগ আছে, সাহস করে মামলা করার পর নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা তাঁর স্বজনেরা পরে চাপে পড়েন, মিটমাটের প্রস্তাব পান। অনেকে মামলা থেকে সরেও আসেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের প্রথম মামলার বাদীও পরে বেঁকে বসেছেন। বাদীর নাম মমতাজ সুলতানা। তিনি তাঁর স্বামী মাহবুবুর রহমানকে (সুজন) হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে ২০১৪ সালের ২০ জুলাই মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা করেন। তাতে মিরপুর মডেল থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমানসহ ১০ জনকে আসামি করেন তিনি। কিন্তু মামলাটির বিচার শুরুর পর জেরার শেষ পর্যায়ে এসে বাদী মমতাজ সুলতানা আদালতে বলেন, ওই দিনের ঘটনা তিনি কিছু মনে করতে পারছেন না। এক নম্বর আসামি এসআই জাহিদকে তিনি কোনো দিন দেখেননি।
অথচ এর আগে মমতাজ আদালতে এজাহারে অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামী ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমানকে প্রথমে তাঁদের হাজারীবাগের বাসায় এসআই জাহিদ ও এএসআই রাজকুমার গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে ও হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বালতি ভরা পানিতে মাথা ডোবান ও পরে লোহার রড দিয়ে পেটাতে থাকেন। এ সময় পুলিশ সদস্যরা দুই লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। তা দিতে না পারায় পাঁচ বছরের ছেলেসহ তাঁকে (মমতাজ) ও মাহবুবুরকে মিরপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানার একটি কক্ষ থেকে বেশ কিছুক্ষণ মাহবুবুরের চিৎকার শোনা গেলেও হঠাৎ তিনি আর কিছু শুনতে পাচ্ছিলেন না। পরে তিনি জানতে পারেন স্বামীর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আছে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিকিৎসক লিখেছেন, আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও শক থেকে মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর ধরন হত্যা।
মাহবুবুরের মা শাহিদা বেগম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যামনে বিচার হইব? শুধু জাহিদ দারোগা ভেতরে। আরও নয়জন কনস্টেবল বাইরে। এগুলিরে কে ধরব? কবে ধরব? এখন ছেলের বউও উল্টে গেছে।’
এসআই জাহিদ এর আগে যখন পল্লবীতে ছিলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে এমন আরেকটি মামলা হয়। ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তির নাম ইশতিয়াক হোসেন (জনি)। তাঁর ভাই মো. ইমতিয়াজ হোসেন মামলা করেন।
ইমতিয়াজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বড় ভাইসহ সাতজনকে ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশ একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে যায়। ওই সাতজনের মধ্যে তিনিও ছিলেন। থানায় পিটিয়ে তাঁর ভাইকে হত্যার পর পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। পরে ইমতিয়াজ আদালতে মামলা করেন। মামলাটি এখন বিচারাধীন।
ইমতিয়াজ বলেন, আসামিদের জাহিদ ছাড়া বাকিরা এখন জামিনে আছেন। তাঁরা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখান।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি নজরুল ইসলামকে ‘ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যার চেষ্টার’ অভিযোগে ১২ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে একটি মামলা রয়েছে। এজাহারে বলা হয়, ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর একটি হত্যা মামলায় নজরুলকে বাড়ি থেকে এনে পায়ে গুলি করে পুলিশ। গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশই তাঁকে নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফেলে যায়। পরে জীবন বাঁচাতে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) তাঁর পা কেটে ফেলতে হয়।
২০১৪ সালে এমন আরেকটি মামলা হয় সিলেটে। কামাল আহমেদ চৌধুরী নামের এক ব্যক্তিকে ওই বছরের ১৭ জুলাই সিলেটের নয়া সড়ক এলাকায় ট্রাফিক আইন ভাঙার অভিযোগে কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি আতাউর রহমান থানায় এনে বেধড়ক মারধর করেন। এই ঘটনায় কামালের ভাই শামীম আহমেদ চৌধুরী নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা করেন। এক বছর পলাতক থাকার পর আতাউর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ বিষয়ে ব্লাস্ট একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে এই আইনটি আরও শক্তিশালী করতে ১৬ দফা সুপারিশ করা হয়।
ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি পাস হওয়ার পর তাঁরা মাত্র দুটি অভিযোগের কথা জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে মানুষ ভয় পায়। উদাহরণ হিসেবে তিনি যশোরের সাম্প্রতিক একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেন।
সম্প্রতি যশোর কোতোয়ালি থানার ভেতর আবু সাঈদ নামের এক যুবককে উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানোর সচিত্র খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আবু সাঈদ এবং অভিযুক্ত এসআই নাজমুল ও এএসআই হাদিবুর রহমানকে আদালতে তলব করেন। আবু সাঈদ গত ২৫ জানুয়ারি আদালতে এসে বলেন, ছবির ওই ব্যক্তি তিনি নন। তাঁকে একা আসতে বলা হলেও তিনি আইনজীবী নিয়োগ দেন এবং পুলিশের পক্ষে সাফাই গেয়ে আদালতে হলফনামা আকারে বক্তব্যও দাখিল করেন।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ১৯৯৮ সালে ডিবি হেফাজতে শামীম রেজা রুবেল নামের এক ছাত্র খুন হওয়ার পর থেকে এমন একটা আইনের জন্য দাবি ওঠে। ২০১৩ সালে আইনটি হয়েছে। এখনো সেভাবে এ আইন সম্পর্কে মানুষ জানেই না। এরই মধ্যে আইনটি বাতিলের দাবি তুলেছে পুলিশ।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র উপমহাপরিদর্শক (মিডিয়া) শহীদুল আলমের সঙ্গে সোমবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি জেনে পরদিন বক্তব্য দেবেন বলেছেন। পরদিন (মঙ্গলবার) মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি আর ফোন ধরেননি। খুদে বার্তারও (এসএমএস) জবাব দেননি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি সংশোধন বা প্রত্যাহারের প্রশ্ন আসে না। বরং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত মানুষকে জানানো যে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যু হলে প্রতিকার আছে, আইন আছে।
mongsai79@gmail.com

Comments