অন্য রকম ভাষার লড়াই

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় চাকমা ভাষাভাষী নারী-পুরুষ ও শিশুদের বিনা মূল্যে চাকমা বর্ণমালার হাতেখড়ি দিচ্ছেন ‘চাঙমা সাহিত্য বা’ নামের একটি সংগঠনের সদস্যরা। শেখানো হচ্ছে পড়া ও লেখা দুটোই। গত শুক্রবার সকালে উত্তর রেংক্যার্যা উচ্চবিদ্যালয়ে স্থানীয় নারী–পুরুষদের বর্ণমালা লেখাচ্ছেন সংগঠনের সভাপতি ইনজেব চাকমা l প্রথম আলোখাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় চাকমা ভাষাভাষী নারী-পুরুষ ও শিশুদের বিনা মূল্যে চাকমা বর্ণমালার হাতেখড়ি দিচ্ছেন ‘চাঙমা সাহিত্য বা’ নামের একটি সংগঠনের সদস্যরা। শেখানো হচ্ছে পড়া ও লেখা দুটোই। গত শুক্রবার সকালে উত্তর রেংক্যার্যা উচ্চবিদ্যালয়ে স্থানীয় নারী–পুরুষদের বর্ণমালা লেখাচ্ছেন সংগঠনের সভাপতি ইনজেব চাকমা l প্রথম আলো
অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকের সংখ্যা না বাড়লে একসময় মৃত ভাষার পরিণতি বহন করতে হবে যেকোনো ভাষাকে। এই সহজ সত্যটা বুঝতে পেরে নিজেদের ভাষা রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালার কয়েকজন উদ্যমী মানুষ। উপজেলায় চাকমা ভাষাভাষী নারী-পুরুষ ও শিশুদের বিনা মূল্যে চাকমা বর্ণমালা পড়তে ও লিখতে শেখাচ্ছেন তাঁরা।
দীঘিনালার পূর্ব কাঁঠালতলি গ্রামের ইনজেব চাকমার (৩২) নেতৃত্বে চাকমা ভাষা রক্ষার এমন লড়াইয়ের নেমেছেন রিপন চাকমা (২৮), সুমিত্র চাকমা (২৬), নমিতা চাকমা (৪০) ও প্রীতি বিকাশ চাকমা (৪৫)। এই লক্ষ্যে ‘চাঙমা সাহিত্য বা’ অর্থাৎ চাকমা সাহিত্য কুটির নামের এই সংগঠনও গড়ে তুলেছেন তাঁরা। এই সংগঠনের উদ্যোগে উপজেলার চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাঠাগারে স্থানীয় বাসিন্দাদের চাকমা বর্ণমালা শেখাচ্ছেন তাঁরা। এ ছাড়া উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে মনের মানুষ গ্রামে স্থাপন করেছেন সাঙু (মাচাংয়ে ওঠার সিঁড়ি) নামের একটি পাঠাগার।
১৭ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় উত্তর রেংক্যার্যা উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে চাকমা বর্ণমালা শেখাচ্ছেন ইনজেব চাকমা ও সুমন চাকমা। বর্ণমালা শিখতে এসেছে প্রাপ্তবয়স্ক লোকজনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে বর্ণ ধরে ধরে উচ্চারণ শেখাচ্ছেন ইনজেব চাকমা ও সুমন চাকমা।
ইনজেব চাকমা জানান, তিনি নিজেও চাকমা বর্ণমালা জানতেন না। ১৯৯৪ সালে গৃহশিক্ষক বীর চাকমার কাছ থেকে বর্ণমালা শেখেন। এর পর নিজেই উপলব্ধি করলেন চাকমা বর্ণমালা শেখার গুরুত্ব। তাই একসময় কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে এ কাজে নেমে পড়েন।
‘চাঙমা সাহিত্য বা’ নামের সংগঠনটির উদ্যোগে প্রতি বৃহস্পতিবার চংড়াছড়ি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ও উত্তর রেংক্যার্যা উচ্চবিদ্যালয়ে, শুক্রবার রেংক্যার্যা উচ্চবিদ্যালয় ও মনের মানুষ এলাকার সাঙু পাঠাগারে পাঠদান করেন তাঁরা।
ইনজেবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ২০০০ সালের ৫ জানুয়ারি ‘চাঙমা সাহিত্য বা’ প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা। এই সংগঠনের উদ্যোগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের চাকমা ভাষা শেখানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৪১৫ জনকে বর্ণমালা শেখানো হয়েছে। চলতি মাসের ৩ তারিখ থেকে আরও ২১০ জনকে শেখানো শুরু করেছেন তাঁরা। সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চাকমা সাহিত্যের প্রকাশনা সংরক্ষণ ও চাকমা জনগোষ্ঠীকে নিজ ভাষার বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত করানো। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এককালীন বইয়ের দাম হিসেবে মাত্র ৫০ টাকা ফি নেওয়া হয়। এ ছাড়া আর কোনো টাকা নেওয়া হয় না। শিক্ষকেরা নিজেদের টাকায় এই কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
এসএসসির পর আর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি ইনজেবের। দুই সন্তানের জনক এই ব্যক্তির এখন একমাত্র কাজ চাকমা লোকজনকে নিজের ভাষার বর্ণমালা শেখানো। ‘পত্তম আদি পুদি’ (প্রথম আদি পুঁথি) নামে বর্ণমালার একটি বইও সম্পাদনা করেছেন তিনি। বইটির মুখবন্ধে লেখা আছে পলান সরকারের উক্তি, ‘বই পড়লে আলোকিত হই, না পড়লে অন্ধকারে রই’। পলান সরকারকে আদর্শ মানেন তিনি।
ইনজেব বলেন, ‘পলান সরকার গ্রামে গ্রামে বই বিলিয়ে মানুষকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। আমরাও পলান সরকারের মতো আমাদের বর্ণমালার সঙ্গে আমাদের জাতিকে পরিচিত করে তুলতে চাই। বিশ্বের অনেক জাতির বর্ণমালা হারিয়ে গেছে। আমরা চাকমা জাতি, কিন্তু আমরা অধিকাংশই আমাদের বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত নই। তাই আমরা চাই আমাদের জাতির সবাই আমাদের চাকমা বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠুক। চাকমা বর্ণমালায় লিখতে পারবে, পড়তে পারবে সবাই। এটাই আমাদের স্বপ্ন।’
রোক্যার্যা উচ্চবিদ্যালয়ে চাকমা ভাষা শিখতে এসেছেন রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এমএসএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নির্মল চাকমা। কেন এসেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাকমা, অথচ আমরা আমাদের বর্ণমালা চিনি না, বর্ণমালায় লিখতে পারি না। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। তাই আমার ইচ্ছা আমার বর্ণমালার সঙ্গে আমি পরিচিত হব। আমার বর্ণমালা আমি শিখব।
দীঘিনালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা বলেন, ‘ চাঙমা সাহিত্য বা নামের সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে চাকমা বর্ণমালা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এটা অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার। এ উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। বাংলা ভাষার জন্য রফিক, শফিক, জব্বারসহ অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে তাঁরাই আমাদের প্রেরণা।’
mongsai79@gmail.com

Comments