সরকার হেফাজতে আত্মসমর্পণ করেছে: ইমরান


চার বছর পূর্ণ করল গণজাগরণ মঞ্চ। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বানে আর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে শাহবাগে এ আন্দোলন শুরু হয়। সংগঠনটির মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। মঞ্চের নানা দিক নিয়ে মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন মোছাব্বের হোসেন
ইমরান এইচ সরকার। ছবি: ভিডিওচিত্র থেকে নেওয়া
প্রথম আলো:
 গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের চার বছর হলো, কতটুকু সফল হয়েছে?
ইমরান এইচ সরকার: এখানে কাগজে-কলমে দাবি আদায়ের হিসাব করা কঠিন। এখানে দুই ধরনের সফলতা আছে। একটি হচ্ছে মানুষের কতটুকু জাগরণ হলো আর দ্বিতীয়টি হলো কাগজে-কলমে কতটুকু দাবি আদায় হলো। যদি প্রথমটি বলি, তাহলে বলব, অনেকটাই সফল হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান একটি দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় ব্যর্থতা হলো মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় বৃত্তের বাইরে রাখা। সে ক্ষেত্রে গণজাগরণ মঞ্চ মুক্তিযুদ্ধকে ও এর স্লোগানগুলোকে দলীয় বৃত্তের বাইরে আনতে পেরেছিল। দ্বিতীয় হচ্ছে মানুষের চেতনার পরিবর্তন করা। এ ক্ষেত্রে গণজাগরণ মঞ্চের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে তরুণদের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। এখন দেখবেন, দেশের যেকোনো স্থানে কোনো অন্যায় সংগঠিত হলে তার প্রতিবাদ করতে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন পড়ে না। যেমন তনু হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশের তরুণেরা এই হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশ অচল করে দিয়েছে। যে তরুণেরা কোনো রাজনৈতিক দলের না। তরুণেরা অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে আপসহীন হয়ে গেছে। গণজাগরণ মঞ্চ তৈরির পর এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। যদি দাবির প্রশ্ন করি, তাহলে দেখবেন ছয় দফা দাবির অনেকগুলো পূরণ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের আইন সংশোধন হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় হয়েছে, রায় কার্যকর হয়েছে। বিচারকে গতিশীল করার দাবিও পূরণ হয়েছে। জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টি অনেক এগিয়েছে। চার বছরে এতগুলো দাবি পূরণ হওয়াও একটি বিরাট সফলতা।
প্রথম আলো: ব্যর্থতার জায়গাটা কোথায়?
ইমরান এইচ সরকার: আমরা বেশ কিছু জায়গায় ব্যর্থ হয়েছি। একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করা হচ্ছে, মেয়েদের স্কুলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো মৌলবাদী, উগ্রবাদী দলগুলোর সঙ্গে আপস করছে। তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এটি একটি বিরাট ব্যর্থতা। আরও একটি বড় ব্যর্থতা হচ্ছে রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির মূল উৎপাটন করা। বাংলাদেশের রাজনীতি বলতে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরন করা। মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে রাজনীতি করা। সেটা বিরোধী দল হোক বা সরকার হোক। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি।
প্রথম আলো: আপনি জানেন যে পাঠ্যবইয়ে এমন একটা পরিবর্তন এসেছে, যা গণজাগরণ মঞ্চের মূল চেতনার সঙ্গে যায় না। অনেকে বলছেন হেফাজতে ইসলামের দাবিকে মেনে নেওয়া হয়েছে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?
ইমরান এইচ সরকার: যেটি করা হয়েছে, তা হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে নেওয়া নয় বা আপস করা নয়, বরং আমি বলব, সরকার হেফাজতে ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং তাদের সব দাবি মেনে নিয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদেরা বলেছিলেন, তাঁরা গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবি মেনে নেবেন। সেখান থেকে সরে গিয়ে সরকার এখন হেফাজতে ইসলামের সব দাবি অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করছেন। হেফাজতের ২৯টি দাবির দু-একটি না মানার কারণে যে বই ছাপা হয়েছিল, তা ঠিক করার জন্য কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে বই বাতিল করে সরকার নতুনভাবে বই ছাপিয়েছে। কতটা আত্মসমর্পণ করেছে এতেই বোঝা যাচ্ছে। সরকারের এই বইয়ের পরিবর্তন ও সামগ্রিক সাম্প্রদায়িকীকরণ ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার বিরোধী। রাষ্ট্র এমন আচরণ করছে যে তারা মৌলবাদীদের পক্ষে ও তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে না। সেই লক্ষণ হিসেবেই কিন্তু বইয়ের এই পরিবর্তনগুলো এসেছে। গণজাগরণমঞ্চ এই চেতনার বিরুদ্ধে।
প্রথম আলো: সামনে কি চ্যালেঞ্জ দেখছেন?
ইমরান এইচ সরকার: দেখবেন, যখনই মঞ্চ গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আন্দোলন করার চেষ্টা করে, তখন আমাদের আন্দোলনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার চেষ্টা হয়। যেমন তনু হত্যার পর গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে দমানোর জন্য মঞ্চকে গৃহবন্দী করার চেষ্টা হয়েছে। এই চেষ্টাকে মোকাবিলা করে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই মঞ্চের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনেও আমরা সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রাজপথে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।
mongsai79@gmail.com

Comments