ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে কেঁচো খুঁড়তে সাপ!


ডোনাল্ড ট্রাম্পযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগাগোড়া বলে এসেছেন, তাঁর দেশের তথ্যমাধ্যম সবচেয়ে অসৎ। তাঁর অন্যতম উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন বলেছেন, মিডিয়াই ট্রাম্প প্রশাসনের প্রধান শত্রু, এ মুহূর্তে তারাই প্রধান বিরোধী দল। শেষ পর্যন্ত দৃশ্যত এই মিডিয়া সজাগ থাকার কারণেই ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ দিনের মাথায় ট্রাম্পকে তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল মাইকেল ফ্লিনকে হারাতে হলো।
তবে এই ফ্লিনই সম্ভবত শেষ নন। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের মধ্যে আরও কয়েকজন এখন মিডিয়ার তোপের মুখে রয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার খবর, গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও সিআইএ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে। পত্রিকাটি জানায়, সংস্থা দুটি মস্কোর সঙ্গে ট্রাম্পের একাধিক সহযোগীর সম্পর্ক তলিয়ে দেখছে।
ট্রাম্প নিজেও তোপের বাইরে নন। রুশ রাষ্ট্রদূত সের্গেই কিসলিয়াকের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে আইনবহির্ভূতভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বলে বিদায় নিতে হয়েছে ফ্লিনকে। এখন মিডিয়াসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই বিষয়ে কথা বলেছিলেন, নাকি খোদ প্রেসিডেন্টের অনুমতি ছিল এর পেছনে? 
মাইকেল ফ্লিনের পদত্যাগের ঘটনাক্রম অনুসরণ করলেই স্পষ্ট হয়, মিডিয়া কেন এখন ট্রাম্পের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। হোয়াইট হাউস স্বীকার করেছে, ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের মাথায়ই ২৬ জানুয়ারি বিচার বিভাগ ফ্লিনের গোপন কথোপকথনের বিষয়টি প্রেসিডেন্টের আইনবিষয়ক উপদেষ্টার গোচরে আনেন। উপদেষ্টা ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি তাঁকে বুঝিয়ে বলেন। কিন্তু ট্রাম্প বিষয়টি ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সকে জানাননি। হয়তো এ জন্যই ফ্লিনের সঙ্গে কথা বলে পেন্স একাধিকবার সাংবাদিকদের বলেছেন, রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তিনি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা বলেননি। কথাটা সত্যি নয় ট্রাম্প তা জানলেও ওয়াশিংটন পোস্ট তা ফাঁস না করা পর্যন্ত ঝাড়া ১৪ দিন নিজের ভাইস প্রেসিডেন্টকেও জানানোর প্রয়োজন দেখেননি।
৯ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে গোমর ফাঁক করার পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প সপ্তাহান্তের ছুটিতে যান। তখন এয়ারফোর্স ওয়ানে সঙ্গী সাংবাদিকদের কাছে ট্রাম্প দাবি করে বসেন, ফ্লিনের কথোপকথনের বিষয়ে তিনি জানেন না, ওয়াশিংটন পোস্ট-এর প্রতিবেদনটিও দেখেননি। তারও দুই দিন পর ট্রাম্পের উপদেষ্টা কেলিঅ্যান কনওয়ে জানালেন, ফ্লিনের ওপর প্রেসিডেন্টের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। সেদিনই মাঝ রাত নাগাদ হোয়াইট হাউস জানাল, ফ্লিন পদত্যাগ করেছেন। পরে এক ভিন্ন ব্যাখ্যায় বলা হলো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফ্লিনের ওপর ‘আস্থা হারিয়েছেন’। সে কারণে ট্রাম্পই তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ১৪ দিন ট্রাম্প সহযোগী পেন্সকেও কেন ফ্লিনের গোপন টেলিফোন আলাপের কথাটি জানাননি? ওয়াশিংটনের পণ্ডিত মহলে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অভাব নেই। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার প্রশ্ন, তবে কি ট্রাম্প নিজেই তাঁর অভিষেকের আগে মস্কোর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন ফ্লিনকে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, বিষয়টি জানার পরও ট্রাম্প কেন ফ্লিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি?
এ দুই প্রশ্নের জবাব হিসেবে ওয়াশিংটন পোস্ট-এ ক্রিস লিজ্জা মন্তব্য করেছেন, ফ্লিন তো চুনোপুঁটি, রাঘব বোয়াল ট্রাম্প। তাঁর মতে, পুতিনের ব্যাপারে ট্রাম্পের ‘বাড়াবাড়ির বিষয়টি’ তদন্ত করলে অনেক বিষয় খোলাসা হবে। এ কথা এখন রক্ষণশীল মহলেও উঠেছে। বর্ষীয়ান সিনেটর লিন্ডসি গ্রাহাম যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে মস্কোর হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেসের নিজস্ব তদন্তের কথা বলেছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্যরাও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছেন।
হোয়াইট হাউস এখন এভাবে ঘরের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। মুখপাত্র শন স্পাইসার বলেছেন, হোয়াইট হাউসের গোপনীয় কথাবার্তা কীভাবে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। ট্রাম্প নিজেও এ ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এ নিয়ে ট্রাম্পের ক্রুদ্ধ টুইটের কারণে দেশের মিডিয়া যে নজর সরিয়ে নেবে, তা মনে হয় না।
চাপে থাকলেও ট্রাম্প এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিডিয়া ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতি নতুন করে চড়াও হয়েছেন। কথিত তথ্য ফাঁসের জন্য এনএসএ ও এফবিআইয়ের নিন্দা করেছেন তিনি। গতকাল এক টুইটে প্রেসিডেন্ট বলেন, গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টকে অবৈধভাবে তথ্য দিচ্ছে। তিনি প্রশ্ন তুলে লেখেন, এ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি ‘এনএসএ ও এফবিআই’? তবে আবার আরেক টুইটে ট্রাম্প বলেন, ওই সব খবর তাঁর প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটদের তৈরি করা ফালতু গল্প ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে যোগসূত্রের অর্থহীন কথাবার্তা হিলারি ক্লিনটনের ব্যর্থ নির্বাচনী প্রচারণার নানা ভুলকে ধামাচাপা দেওয়ার কৌশল মাত্র।’
অন্যদিকে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ গতকাল বলেছেন, ট্রাম্পের সহযোগীদের সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগের সাম্প্রতিকতম খবরের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। আগের দিন মঙ্গলবার ক্রেমলিন বলেছিল, উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনের পদত্যাগের বিষয়টি ওয়াশিংটনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
ওয়াশিংটনের তথ্যাভিজ্ঞ মহল জানাচ্ছে, ফ্লিনের প্রস্থানের পর ট্রাম্পের আরও দুই বা তিনজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিপদের মধ্যে রয়েছেন। তাঁদের একজন ট্রাম্পের সাবেক ক্যাম্পেইন ম্যানেজার, বর্তমানে ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা কেলিঅ্যান কনওয়ে। তিনি ট্রাম্পের কন্যা ইভানকার কোম্পানির কাপড়চোপড় নিয়ে টিভির পর্দায় বিজ্ঞাপন করেছেন, যা সরকারি বিধিমালাবিরোধী। সরকারের নৈতিকতাবিষয়ক দপ্তর বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে চিঠি লিখেছে। তবে ট্রাম্প কনওয়ের পক্ষে থাকায় তিনি চাকরি নিয়ে আপাতত বিপদে নেই বলে কারও কারও ধারণা।
অন্যদিকে ট্রাম্পের চিফ অব স্টাফ রিন্স প্রিবাসও চাপের মুখে। বলা হচ্ছে, হোয়াইট হাউসের বর্তমান বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কনওয়ে নাকি প্রিবাসের চাকরিটি নিজের জন্য চান, এমন কথাও শোনা গেছে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র শন স্পাইসারের কাজ নিয়ে ট্রাম্প খুশি নন—এ কথা জানিয়েছে হোয়াইট হাউস সূত্রই। বলা হয়েছে, স্পাইসারের ‘কাজের চাপ কমাতে’ একজন কম্যুনিকেশন্স ডিরেক্টর খোঁজা হচ্ছে।
mongsai79@gmail.com

Comments