ভাবনা কেন্দ্র নিয়ে দৈনিক জনকন্ঠের জঘণ্য মিথ্যাচার : বৌদ্ধরা শঙ্কিত

আজ ২৪ এপ্রিল দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় ফিরোজ মান্না লিখিত “পার্বত্য এলাকায় নতুন অশান্তি সৃষ্ঠির চেষ্টায় ভাবনা কেন্দ্র” শিরোনামে সেরকম একটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদ পরিবেশন হয়েছে। এই সংবাদ পরিবেশনের উদ্দেশ্য নিয়ে বৌদ্ধরা শঙ্কিত। সংবাদটিতে লিখা হয়েছে- সরকারের খাস জমি দখল করে ভাবনা কেন্দ্র বা কিয়াং গড়ে তুলে সেখানে মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়বাদী গোষ্ঠী ৯৬৯ উপজাতিদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। সংবাদটির প্রথমদিকে লেখা হয়েছে ৩৫ জনের বেশী মিয়ানমারের নাগরিক এই কাজ করছে ভান্তে বা ধর্মযাজক সেজে। একই সংবাদের পরবর্তী অংশে লেখা হয়েছে কয়েকশ ভান্তে এই কাজ করছে অর্থাৎ পাহাড়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার পায়তারা করছে। এতে স্পষ্টতঃ বুঝা যায় প্রতিবেদকের এক অংশের সাথে আরেক অংশের গড়মিলের বিষয়টি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, উভয় অংশেই গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে কথাগুলো বলা হয়েছে।

প্রশ্নটি স্বভাবতই চলে আসে, বাংলাদেশ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এরকম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে সেগুলো কি সাংবাদিককে জানায় দৈনিক পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারের জন্য? সংবাদটিতে দেখা যায় বান্দরবানের স্বর্ণমন্দির, রাঙ্গামাটির বনবিহার ও রাজবন বিহার এই তিন প্যাগোডায় কাউকে ঢুকতে না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে নাকি মিয়ানমারের ঐ সকল সদস্যরা। সেখানে নাকি গোপনে জুডো ক্যারাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা বনে ঢুকে পড়েছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে রাঙ্গামাটিতে বনবিহার ও রাজবন বিহার নামে আলাদা আলাদা কোন প্রতিষ্ঠান নেই। রাঙ্গামাটিতে রাজবন বিহার নামে একটিই প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেটি রাঙ্গামাটির জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছেই সমভাবে গ্রহণযোগ্য। এক প্রতিষ্ঠানকে দুটি বানিয়ে মোট তিনটি প্যাগোডা নাম দিয়ে সরেজমিনে যাওয়ার কথা বলে প্রতিবেদক এখানে চুড়ান্ত মিথ্যাচার করেছে। বান্দরবানের স্বর্ণমন্দির এবং রাঙ্গামাটির রাজবন বিহার সবার কাছে আকষর্ণীয় স্থান। এগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং সৌন্দর্যের কারণে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। তবে ওখানে বেড়াতে গিয়ে অশ্লিলভাবে ছবি তোলা, শুটিং স্পটে পরিণত করা সহ নানাভাবে বৌদ্ধ মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করার কারণে কর্তৃপক্ষ পুজারী ব্যতীত অন্যদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কেবলমাত্র বৌদ্ধ বিহারের পবিত্রতা রক্ষার্থে। এখানে কাউকে প্রবেশে যে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে সেটাও চরম মিথ্যাচার কারণ এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে প্রতিদিন শত শত বৌদ্ধরা যায়, অনেক সময় কৌতুহলবশত বৌদ্ধ বেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও প্রবেশ করে যেহেতু চেহারা দেখে বুঝা যায় না কে বৌদ্ধ, কে হিন্দু। মূলত এই সংবাদটির মাধ্যমে প্রতিবেদক এটি প্রকাশ করতে চেয়েছে যে, পার্বত্য বৌদ্ধরা সরকারের বিরুদ্ধে অনেক শক্তভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, অন্যদিকে তার কথায় মনে হচ্ছে এই সব তথ্য গোয়েন্দা সংস্থারা তাকে একের পর রিপোর্ট আকারে দিচ্ছে যা তিনি প্রকাশ করছেন। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এমন তথ্য থাকলে তা জানার কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সুনির্দিষ্ট অপরাধী থাকলে তার বিরুদ্ধে গোপন অভিযান চালানোর কথা সরকারেরই। সেখানে তেমন কিছু না করে গোয়েন্দা সংস্থা পত্রিকায় খবরগুলো প্রচার করবে সাংবাদিকের মাধ্যমে এমনটা বিশ্বাস করা হাস্যকর ব্যাপার। মিথ্যাচারের শেষ পর্যায়ে গিয়ে প্রতিবেদক উইকিপিডিয়ার নাম ভাঙ্গিয়ে ৯৬৯ এর ব্যাখ্যা দিতে গিযে তুলে ধরেছেন- ৯ দ্বারা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাদের দেবতা সন্ত্রাসী গৌতম বুদ্ধের গুণ, ৬ দ্বারা সন্ত্রাসী গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা…বুঝিয়েছে। এই কথাগুলো থেকে স্পষ্ট হয়েছে গৌতম বুদ্ধের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত এবং সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিবেদক এমন প্রতিবেদন তৈরী করেছেন। আর তাই তিনি শেষের দিকে লিখেছেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের তৈরী এই সংগঠনের মুল টার্গেট হচ্ছে মুসলমানরা। অথচ বাংলাদেশী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমান তো দূরে থাক কোনদিন মানুষ খুন করেছে এমন রেকর্ড কোথাও পাওয়া যায় না।

প্রিয় পাঠক, এটা সত্য যে মিয়ানমারে নানা সময়ে নানা কারণে রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। আর এসবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পাহাড়ী বৌদ্ধরা থেকে শুরু করে সমতলীয় বৌদ্ধরা প্রতিবাদ জানিয়েছে মানব বন্ধন করেছে, যা বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনটি এমন এক সময় প্রকাশিত হয়েছে যখন পার্বত্য অঞ্চলে রমেল চাকমা নিহত হয়েছে যার লাশটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের সুযোগ পায় নি তার পরিবার। তবে কি সেই বিষয়টি আড়াল করতে সেই বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বৌদ্ধরা যেন এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয় তাই চেয়েছে প্রতিবেদক? নাকি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনই মূল টার্গেট। এদেশে ফেইসবুকে ফটোশপের এডিট করা ছবির মাধ্যমে অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার একসাথে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রামুতে। তবে কি এধরণের প্রতিবেদন করে নতুন ভাবে মুসলিম জনতাকে উত্তেজিত করে নির্বাচনের আগে পরিবেশ ঘোলাটে করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যেই এই ভুয়া প্রতিবেদন? উদ্দেশ্য যেটাই হোক বৌদ্ধরা আজ শঙ্কিত রামু ট্রাজেডির মতো আসন্ন কোনো বিপদের কথা ভেবে। দৈনিক জনকন্ঠের মতো পত্রিকা থেকে আমরা এমন হলুধ সাংবাদিকতা চাই না যেমনটা করেছিল আমার দেশ পত্রিকা। আমাদের দেশ পত্রিকায় ভারতে শর্ট সার্কিটে পুড়ে যাওয়া মাজারের ছবি দিয়ে মায়ানমারে মসজিদ পুড়ে দেওয়ার ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরের দিন দুঃখ প্রকাশ করলেও ততক্ষণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় অনেকেই। আবার কেউ কেউ মায়ানমারে কিছু হলেই ইন্টারনেট থেকে ঘুর্ণিঝড় কিংবা ভুমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের ছবি দিয়ে মিয়ানমারের নির্যাতন বলে প্রচার করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে। আমরা এমন হলুধ সাংবাদিকতা চাই না। যে কোনো নির্যাতনকে আমরা ঘৃণা করি। সবকথার শেষ কথা, আমরা এদেশে শান্তিতে বাঁচতে চাই, শঙ্কায় নয়।
mongsai79@gmail.com

Comments