১২ এপ্রিল আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ফুল বিজু


আদিবাসী উৎসব
প্রতি বছরের ন্যায় এই বছর ও পালিত হচ্ছে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী প্রধান উৎসব বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু ,বিষু ,বিহু ,সাংক্রান ইত্যাদি ।

আসন্ন ঐতিহ্যবাহী উৎসব উপলক্ষ্যে থাকছে বিভিন্ন আয়োজন । এ বছর রাঙ্গামাটিতে বিজুমেলা উদ্বোধন করবেন চাকমা চিফ সার্কেল ব্যারিষ্টার দেবাশীয় রায় । প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন মাননীয় সংসদ সদস্য শ্রী ঊষাতন তালুকদার । সভাপতিত্ত্ব করবেন শ্রী প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা । এছাড়া বক্তব্য রাখবেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ।

বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রধান ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসাবি সাধারণত তিন আদ্যাক্ষর নিয়ে সৃষ্টি। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু(ত্রিপুরা,মারমা,চাকমা) ঐতিহ্যবাহী উৎসবের প্রধান অক্ষরগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে বৈসাবি শব্দটি উৎপত্তি হয় । যদিও এটি বিভিন্ন নামে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির নাম অনুসারে এখনো বিদ্যমান রয়েছে । বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু ,বিষু ,বিহু ,সাংক্রান ইত্যাদি । 

বাংলাদেশে তিন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব এটি। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় তারা। আদিবাসীরা বর্ষবরণ উৎসব পালন করে বিভিন্ন নামে। কেউ বৈসু, কেউ সাংগ্রাই আবার কেউ বিজু। বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে অভিহিত করে এবং এগুলি বৈসাবি নামে পরিচিত। সাধারণত বছরের শেষ দুইদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালিত হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়।

বৈসুঃ ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বৈসু। বৈসু উৎসব এদের জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। বৈসু উৎসব একটানা তিন দিন পালন করা হয়। এই তিন দিনের অনুষ্ঠানগুলির নাম হলো হারি বৈসু, বিসুমা বৈসু ও বিসিকাতাল বা আতাদাং বৈসু। বৈসু উৎসবের প্রথম দিন হারি বৈসু। এই দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারা ঘরদোর লেপেপোঁছে, বসতবাড়ি কাপড়চোপড় পরিস্কারপরিচ্ছন্ন করে। ত্রিপুরারা বিশেষ একপ্রকার গাছের পাতার রস আর হলুদের রস মিশিয়ে গোসল করে। ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায়। গবাদিপশুদের গোসল করানো হয় এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়।

শিশুরা বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করে। তরুণতরুণীরা প্রিয়জনকে ফুল উপহার দেয়। দেবতার নামে নদীতে বা ঝর্ণায় ফুল ছিটিয়ে খুমকামীং পূজা দেওয়া হয়। কেউ কেউ পুষ্পপূজা করে। এদিন মহিলারা বিন্নি চাউলের পিঠা ও চোলাই মদ তৈরি করে। পুরুষেরা বাঁশ ও বেত শিল্পের প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলায় মেতে উঠে। এদিন এরা দাং, গুদু, চুর, সুকুই, উদেং ও ওয়াকারাই খেলায় অংশগ্রহণ করে। জুম কৃষক পাড়ার মধ্যে হাঁসমুরগির জন্য শস্যদানা ছিটিয়ে দেয়। হারি বৈসু উৎসবের দিন থেকে এরা গরয়া নৃত্য পরিবেশন শুরু করে। এ নৃত্য সাত দিন থেকে আটাশ দিন পর্যন্ত চলে। ঢোলের তালে তালে সারিবদ্ধভাবে লোকজন নাচে। নাচ শেষে গরয়া পূজার ব্যবস্থা করা হয়।

উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিসুমাতে ত্রিপুরারা নববর্ষকে স্বাগত জানায়, ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে পূজা দেয় ও উপাসনা করে। সবাই গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুর বেড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাচন, সেমাই ও মিষ্টি খায় এবং কলাপিঠা, চুয়ান পিঠা, জাল পিঠা, উন পিঠা ও মায়ুং পিঠা খায়। এছাড়া এদিন তারা নিরামিষ ভোজন করে। কোনো প্রাণি বধ করে না। অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন বিসিকাতালে আমিষ খাবার গ্রহণে বাধা নেই। এদিনও ফুল দেওয়া হয় ও উপাসনা করা হয়। তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের গোসল করিয়ে পায়ের কাছে পূজার নৈবেদ্য হিসেবে ফুল রাখে এবং প্রণাম করে। কেউ কিছু না খেয়ে ফিরে না যায় সেজন্য সারাদিন ঘরের দরজা খোলা থাকে। এতে গৃহস্থের কল্যাণ হবে বলে মনে করা হয়।

সাংগ্রাইঃ মারমা আদিবাসীরা বর্ষবরণের এই উৎসব কে পালন করেন সাংগ্রাই নামে। এ উৎসব চলে ৪দিন ধরে। মারমাগণ সবাই বুদ্ধএর ছবি সহকারে নদীর তীরে যান এবং দুধ কিংবা চন্দন কাঠের জল দিয়ে এ ছবিটিকে স্নান করান। তারপর আবার এই ছবিটিকে আগের জায়গায় অর্থাৎ মন্দির বা বাসাবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মারমা সম্প্রদায় সেই আদিকাল থেকে অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে আসছে, যা মারমা ভাষায় সাংগ্রাই নামে পরিচিত। মূলত 'সাক্রাই' (সাল) শব্দ থেকেই 'সাংগ্রাই' শব্দ এসেছে বলে ধারণা করা হয়। যা বাংলাই 'সংক্রান্তি' বলে পরিচিত। মারমা সম্প্রদায়ের 'সাংগ্রাই জ্যা'র (মারমা বর্ষপঞ্জি) গঠনের মাধ্যমে সাংগ্রাইয়ের দিন ঠিক করা হয়ে থাকে। মাইংমা ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দের আগে থেকেই এ 'সাক্রাই' বা সাল গণনা করা হয়, যা 'জ্যা সাক্রই' নামে পরিচিত।

সাংগ্রাইয়ের উৎপত্তি নিয়ে মারমা ভাষায় বিভিন্ন কল্পকাহিনী বিদ্যমান রয়েছে, যা এখনো মারমা বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে প্রচলিত। কবে থেকে মারমাদের সাংগ্রাই উদ্যাপন শুরু হয় এ ব্যাপারে সঠিক কোনো ইতিহাস এখনো পাওয়া যায়নি। সাংগ্রাই উৎসবটি মারমারা তিন দিনব্যাপী উদ্যাপন করে। সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিনকে মারমা ভাষায় 'সাংগ্রাই আক্যা' বা 'পাইং দোয়াক' (সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিন পুষ্প আহরণ)। দ্বিতীয় দিনকে 'সাংগ্রাই বাক্' (সাংগ্রাইয়ের দিন) এবং তৃতীয় দিনকে 'সাংগ্রাই আপ্যাইং' (সাংগ্রাই বিদায়) নামে পরিচিত। এই তিন দিন মারমারা নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে ।

বিজুঃ চাকমা আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান আনন্দ-উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়।১২ এপ্রিল পালন করা হয় ফুলবিজু। এই দিন ভোরের আলো ফুটার আগেই ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ে ফুল সংগ্রহের জন্য। সংগ্রহিত ফুলের একভাগ দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করা হয় আর অন্যভাগ পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বাকি ফুলগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়।চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাত্‍ ১৩ এপ্রিল পালন করা হয় মুলবিজু। এইদিন সকালে বুদ্ধমূর্তি গোসল করিয়ে পূজা করা হয়। ছেলেমেয়েরা তাদের বৃদ্ধ দাদা-দাদী এবংনানা-নানীকে গোসল করায় এবং আশীর্বাদ নেয়। এই দিনে ঘরে ঘরে বিরানী সেমাই পাজন (বিভিন্ন রকমের সবজির মিশ্রণে তৈরি এক ধরনের তরকারী) সহ অনেক ধরনের সুস্বাদু খাবার রান্না করা হয়। বন্ধুবান্ধব আত্নীয়স্বজন বেড়াতে আসে ঘরে ঘরে এবং এসব খাবার দিয়ে তাদেরকে আপ্যায়ন করা হয়। সারাদিন রাত ধরে চলে ঘুরাঘুরি। বাংলা নববর্ষের ১ম দিন অর্থাত্‍ ১৪ এপ্রিল পালন করা হয় গজ্যা পজ্যা দিন (গড়িয়ে পড়ার দিন)। এই দিনেও বিজুর আমেজ থাকে।
রাঙ্গামাটিতে বিজুমেলায় এ বছর যা থাকছে আসুন এবার জেনে নিই কবে কোথায় কোন অনুষ্ঠান পালন করা হবেঃ

৯ এপ্রিল ২০১৭ রবিবার(শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযগিতা ও প্রদর্শনী,বিকালঃ৩ ঘটিকায়,রাংগামাটি মারি স্টেডিয়াম )

১০ এপ্রিল ২০১৭ সোমবার(ঐতিহ্যবাহী আদিবাসীদের জুম্ম খেলাধুলা,সকালঃ৯ ঘটিকায়,রাঙ্গামাটি মারি স্টেডিয়াম,বিকালঃ৪ ঘটিকায় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান)

১১ এপ্রিল ২০১৭ মঙ্গলবার (আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী বলিখেলা,বিকালঃ ৩ ঘটিকায়,ও বিকালঃ৬ঘটিকায়  কবির কন্ঠে কবিতা পাঠ)

১২ এপ্রিল ২০১৭ বুধবার(ঐতিহ্যবাহী ফুল ভাসানো অনুষ্ঠান,সকালঃ৬ ঘটিকায় রাঙ্গামাটি রাজবন বিহার পুর্বঘাট)

এছাড়া ১৩ এপ্রিল পাহাড়িদের স্ব স্ব বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু ,বিষু ,বিহু ইত্যাদি মূল অনুষ্ঠান রাংগামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের আদিবাসীদের প্রধান উৎসব পালিত হবে।এছাড়া১৪ এপ্রিল নতুন বছর পালন করা হবে।
বিদ্রঃ খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার এই বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রধান উৎসবের সময়সূচি এখনো হাতে না পাওয়ার কারণে প্রকাশ করা যাচ্ছেনা ।
mongsai79@gmail.com

Comments