ত্রিপুরা মেয়ে সাধনায় সকাল হলো

কেরোসিন কেনার টাকা থাকত না, তাই দিনের পড়া দিনেই শেষ করতে হতো সাধনা। সেই সাধনা এখন ত্রিপুরা নারীদের মধ্যে প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট। পিন্টু রঞ্জন অর্ককে বলেছেন হারতে না চাওয়া দিনগুলোর কথা। ছবি তুলেছেন তারেক আজিক নিশক


সাধনায় সকাল হলো
কাকডাকা ভোরেই মা-বাবা চলে যেতেন মাঠে। দিনভর কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হতো।
পরিবারের বড় মেয়ে আমি। ছোট চার ভাই-বোন। সারা দিন ওদের দেখে-শুনে রাখার দায়িত্বটা পড়ত আমার ঘাড়ে।

গৌমতী গ্রামে আমাদের বাড়ি
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা উপজেলা। সেখানকার গৌমতী গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমার প্রথম স্কুলের নাম গৌমতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাড়ি থেকে বেশি দূরে ছিল না। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই যেতে পারতাম না। তবে যেদিন যেতাম মনোযোগ দিয়েই ক্লাস করতাম। কোনো কিছু একবার পড়লেই মনে থাকত। স্যাররাও স্নেহ করতেন। গণিত আর ইংরেজি পড়াতেন কৃত্তিত্তম স্যার (কৃত্তিত্তম চাকমা)। একদিন তিনি মাকে ডেকে পাঠালেন। কী কী যেন বললেন। শেষে আমাকে বললেন, পড়াশোনায় আরেকটু মন দাও। দিনের পড়া দিনেই শেষ করতাম। সন্ধ্যার পরপরই বিছানায় যেতে হতো। কেরোসিন তেল কেনার টাকা আমাদের ছিল না।

বন্যায় কষ্ট বেড়েছিল
আটানব্বই সালের বন্যার পর আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তিনবেলা খাবার পাওয়াও সহজ ছিল না। মা গরু-হাঁস-মুরগি পেলে একরকম চালানোর চেষ্টা করছিলেন। বাবার চাষবাস বন্ধ ছিল। আমাদের খড়ের চালাঘর ছিল। ফি বছর খড় পাল্টাতে হতো। কিন্তু সেবার আর সম্ভব হয়নি। রাতে বৃষ্টি হলে কষ্ট হতো খুব বেশি।

বছর দুয়েক স্যারের বাসায় ছিলাম
তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। কৃত্তিত্তম স্যার নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন আমাকে। খাওয়াতেন-পড়াতেন। সেখানে থেকেই বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তারপর স্যার এক দিন দৌড়ে এসে বলেছিলেন, ‘তুই তো আমাদের মুখ উজ্জ্বল করছিস। বৃত্তি পাইছিস। ’ মাসিক ১৫০ টাকা পেতাম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য গৌমতী বিকে উচ্চ বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলাম। ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলাম। স্যার ভর্তির টাকা দিয়েছিলেন। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত স্যারের বাসায় ছিলাম।

স্কুলটা দূরে ছিল
হাই স্কুলটা বাড়ি থেকে বেশ দূরে ছিল। হেঁটে হেঁটে যেতাম। সকাল সকাল রওনা দিতাম। বর্ষা-বাদলের দিনে বেশি কষ্ট হতো। ৪টার দিকে স্কুল ছুটি হতো। এরপর টিউশনি করতে যেতাম। চারজনকে পড়িয়ে ৬০০ টাকার মতো পেতাম। সেই টাকা দিয়ে নিজের খরচ চালাতাম। মায়ের হাতেও কিছু দিতাম। টিউশনি শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত।

আমার একটা বান্ধবী ছিল
আমাদের সময়ে স্কুলে পাঠ্য বই কিনতে হতো। তবে সব বই কিনে উঠতে পারতাম না। বিশেষ করে ইংরেজি আর বাংলা ব্যাকরণের বইগুলো। আমার একটা বান্ধবী ছিল। তার বাসায় গিয়ে খাতায় রচনা, প্যারাগ্রাফ, অ্যাপ্লিকেশন—এসব লিখে আনতাম। খাতায় বেশির ভাগ সময় পেনসিল দিয়ে লিখতাম। এর সুবিধা ছিল। নতুন কিছু লিখতে হলে ইরেজার দিয়ে মুছে নিয়ে আবার লিখতে পারতাম। এভাবে এক পৃষ্ঠা চার-পাঁচবার ব্যবহার করতাম। আমার ভাই-বোনদেরও সেভাবেই শিখিয়েছি।

একসময় বিয়ের কথা উঠল
আমাদের এলাকার মেয়েদের সেভেন-এইটেই বিয়ে হয়ে যেত। আমার বিয়ের কথাও উঠল। অনেকে এসে মাকে বলত—‘মেয়ে তো ডাঙর হয়া গেছে, বিয়ের বয়স পার হয়া যাইতাছে। দেরি করতাছ ক্যান। দিয়ে দাও। ’ আবার কেউ কেউ বলত, ‘শুধু শুধু স্কুলে পাঠায়া টাকাগুলো জলে ফেলতেছ। ’ আমি সব সময় চাইতাম টাকার চাপটা যেন মায়ের ওপর না পড়ে। তাহলেই বিয়ের কথা বেশি বেশি উঠবে। বুঝ হওয়ার পর থেকে কোনো দিন মা-বাবার কাছে টাকা চেয়েছি বলে মনে পড়ে না।

এসএসসি দিলাম
বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলাম। ২০০৬ সালে এসএসসি দিলাম। পাস করে খাগড়াছড়ি মহিলা কলেজে (তখনো সরকারি হয়নি) ভর্তি হলাম। জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মনিন্দ্রলাল ত্রিপুরা ভর্তি ও হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরিবার-পরিজন থেকে অনেক দূরে। খুব মন খারাপ হতো। জানালা দিয়ে আলুটিলার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

একজন রুবাইয়াত স্যার
ইংরেজির নিয়মিত কোনো শিক্ষক ছিল না কলেজে। রুবাইয়াত ই আশিক নামের একজন এসিল্যান্ড (সহকারী কমিশনার—ভূমি) প্রতি সপ্তাহে কলেজে আসতেন। ঘণ্টাখানেক আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। ক্লাস টেস্টও নিতেন। সেই সব টেস্টে প্রথম হতাম। তিনি ডায়েরি, কলম ইত্যাদি উপহার দিতেন। বলতেন, ‘তোমার তো বেসিক ভালো। একটু চেষ্টা করলেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে হয়ে যাবে। ’ তিনি বরাবরই উৎসাহ দিতেন। ২০০৮ সালে জিপিএ ৪ দশমিক ০২ পেয়ে এইচএসসি পাস করি।

বীণা ত্রিপুরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন
২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা সাহিত্যে পড়ার ইচ্ছা ছিল। ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি ফরমও কিনেছিলাম। কিন্তু টাইফয়েডের কারণে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারিনি। যাই হোক ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। লিখিত পরীক্ষা পাসের পর ভাইভা দিতে আসার সময় টাকায় টান পড়ল। তখন থাকতাম খাগড়াছড়ি শহরে পিসির (শাপলা ত্রিপুরা) বাসায়। পিসি নিজের জন্য দিনকয় আগে পিনন খাদি (ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক) কিনেছিলেন। সেটি বিক্রি করে আমার হাতে দিলেন। বললেন, ‘আগে ভর্তি হ। ’ ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্টে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হলাম। এবার সমস্যা হলো ভর্তির টাকা নিয়ে। আমাদের এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন জ্যোতিন্দ্র লাল ত্রিপুরা। তিনি ভর্তির টাকা দিলেন। লোকমুখে শুনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন রাঙামাটির বীণা ত্রিপুরা নামের একজন। তিনি আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন। তাঁকে এখন ‘মা’ বলে ডাকি। ক্যাম্পাসে আমার ঠিকানা বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব হল। তবে শুরুতেই হলে সিট পাইনি। বরেন্দ্রলাল ত্রিপুরা নামে এক কাকা থাকতেন শ্যামলীর রিং রোডে। তাঁর বাসায় উঠেছিলাম।

অসুখবিসুখ লেগেই থাকত
ঢাকায় এসে খাওয়াদাওয়ায় খুব সুবিধা হচ্ছিল না। শরীর ঢাকার খাবার নিতে পারত না। তাই অসুখে পড়তাম নিয়মিত। ক্লাস করা হতো না। বন্ধুরাই ছিল ভরসা। ক্লাস লেকচার কিংবা অ্যাসাইনমেন্ট—বন্ধুরা সব কিছুতে সাহায্য করেছে। বিবিএতে রেজাল্ট আরো ভালো হতে পারত। সিজিপিএ চারের মধ্যে ৩ দশমিক ০৬ পেলাম। এমবিএর শুরু থেকেই চাকরির জন্য প্রস্তুত হতে থাকলাম। ক্লাস শেষে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে যেতাম। রাত সাড়ে ৮টায় লাইব্রেরি বন্ধ হলে ফিরতাম। তারপর মুখে কিছু গুজে দিয়ে আবার পড়তে বসতাম। জানতাম, কিছু করতে হলে আমাকেই করতে হবে। এমবিএতে সিজিপিএ চারের মধ্যে ৩ দশমিক ৪৬ পেলাম। এর মধ্যেই ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দিল। আবেদন করলাম। প্রথম পছন্দ প্রশাসন ক্যাডার। সফলভাবেই প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হলাম। এর মধ্যেই হল ছাড়তে হয়।

টিউশনি করেই চলতাম
এমবিএ শেষ করার পর ঢাকায় একটা পার্টটাইম চাকরির খুব চেষ্টা করেছি। কাজ হয়নি। বাধ্য হয়ে খাগড়াছড়ি ফিরে যাই। একটা বাসা ভাড়া নিলাম। টিউশনি করাতাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চার-পাঁচটা ব্যাচ পড়াতাম। এদিকে আমার ভাইদের মধ্যে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজম্যান্ট এবং অন্যজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিকসে পড়ে। ছোট বোনটা পড়ে রাঙামাটি সরকারি কলেজে। টিউশনি আর চাকরির বেতন দিয়ে নিজে চলতাম, ভাই-বোনদের চালাতাম। বেশ ভালোমতোই লিখিত পরীক্ষা দিলাম। মৌখিক পরীক্ষাও বেশ ভালো হলো।

একদিন স্বপ্নের দিন
২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট। দুপুরে খেয়ে ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকেলে ফোন খুলে দেখি, শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন জানিয়ে কয়েকটা এসএমএস। ছোট ভাইটা আমাকে ফোনে পেয়ে বলল, ‘সেই কখন থেকে চেষ্টা করছি। আরে তুই তো পাস করে গেছিস। ’ তখনো আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। দোকানে গিয়ে রিচার্জ করলাম। পিএসসির ওয়েবসাইটে যখন নিজের নাম দেখলাম তখন চোখের পানি বাঁধ মানল না।

Comments