বান্দরবানে গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতীত জামিনে থাকা জুম্মদেরকে গোয়েন্দা ও সেনাবাহিনী কর্তৃক অবৈধভাবে আটক ও নির্যাতন


সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতীত জামিনে থাকা জুম্ম গ্রামবাসীদেরকে গোয়েন্দা ও সেনাবাহিনীর সদস্য কর্তৃক অবৈধভাবে আটক করে বান্দরবান সেনা জোনে নিয়ে মারধর ও মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেলে প্রেরণের ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে। এভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে জুম্মদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ হলো নিম্নরূপ-
১। গত ১৪ জুলাই ২০১৭ দিবাগত রাত আনুমানিক ৩:৩০ টার দিকে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় রুমা সেনা গ্যারিসনের ২৯ বেঙ্গলের কম্যান্ডার লে: কর্ণেল আতিকুর রহমান ও মেজর মেহেদির নেতৃত্বে সেনা ও পুলিশের একটি দল জনসংহতি সমিতির রুমা থানা কমিটির সদস্য ও রুমা সদর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য শৈহ্লাপ্রু মারমাকে (৫০) রুমা বাজারের ইডেনপাড়া রোড়ের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
২। গত ৩ জুলাই ২০১৭, দুপুর ১২:০০ টার দিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন রোয়াংছড়ি উপজেলার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়ন কমিটি’র সাংগঠনিক সম্পাদক রাঙ্গোলাল তঞ্চঙ্গ্যা (৪৭) বান্দরবান জেলা সদরস্থ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন একটি সাজানো মামলায় যথারীতি আদালতে হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় দুপুর আনুমানিক ১২:৩০ টার দিকে বান্দরবান ডিসি অফিসের পশ্চিম দিক থেকে সাদা পোশাক পরিহিত গোয়েন্দা বিভাগের তিনজন লোক রাঙ্গোলাল তঞ্চঙ্গ্যাকে জোরপূর্বক আটক করে মোটর সাইকেলে তুলে নিয়ে যায়। এছাড়া সেদিন সকাল ১১ টার দিকে বান্দরবানের বালাঘাটা যাত্রীছাউনি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির সদস্য রিপন তঞ্চঙ্গ্যাকে (২৫) সাদা পোষাকধারী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। রাঙ্গোলাল ও রিপনকে বান্দরবান সেনা জোনে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করার পর মিথ্যা মামলায় জড়িত করে বিকাল ৫ টার দিকে বান্দরবান থানায় সোপর্দ করে।
৩। গত ১২ জুন ২০১৭ সাল বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলা সদরের ওয়াগই পাড়ার বাসিন্দা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রোয়াংছড়ি থানা শাখার ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক অনিল তঞ্চঙ্গ্যার (৩৫) বান্দরবানের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে নিয়মিত হাজিরা দিতে আসলে হাজিরা দেয়ার পূর্বে কোর্ট বারান্দা থেকে বেলা ১:৩০ টার দিকে তিনজন ডিজিএফআই/এফআইইউ সদস্য তাকে ধরে বান্দরবান সদর জোনে নিয়ে যায়। জোনে সেনাসদস্যরা অনিল তঞ্চঙ্গ্যাকে অমানুষিকভাবে মারধর করে এবং গুরুতর আহত অবস্থায় বিকাল ৫:০০ টার দিকে বান্দরবান সদর থানায় সোপর্দ করে। এ সময় পুলিশ অনিল তঞ্চঙ্গ্যাকে ২০১৬ সালের ১৫ জুন তারিখে দায়েরকৃত সাজানো অপহরণ মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামী হিসেবে দেখিয়ে জেলে প্রেরণ করে।
৪। ১৮ মার্চ ২০১৭ সকাল আনুমানিক ৬:৩০ টার দিকে বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক-আমতলি সেনাক্যাম্পের একদল সেনাসদস্য টংকাবতী ইউনিয়নের টংকাবতী চাকমা পুনর্বাসন পাড়ার বাসিন্দা ও জনসংহতি সমিতির টংকাবতী ইউনিয়ন কমিটির সদস্য বিপ্লব চাকমা (৩৩) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির টংকাবতী ইউনিয়ন কমিটির সদস্য অমর চাকমাকে (৩২) আটক করে নিয়ে গেছে। আটককৃতরা সেসময় বাড়ি থেকে বের হয়ে স্ব স্ব জমিতে কাজে যাচ্ছিল। তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা বা কোন ওয়ারেন্টও ছিল না।
জামিনে থাকা ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ লোকজনদেরকে এভাবে অবৈধভাবে ধরে নিয়ে বিচার-বহির্ভূত শারীরিক নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেলে প্রেরণের ঘটনা সরাসরি সংবিধানের স্বীকৃত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের সামিল বলে বিবেচনা করা যায়। এধরনের ঘটনা কখনোই আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিচায়ক বহন করে না।
উল্লেখ্য যে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের নামে সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-বিজিবি ও ক্ষমতাশালী স্থানীয় মহল কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও সহযোগী সংগঠনের সদস্য ও সমর্থকসহ সাধারণ জুম্ম গ্রামবাসীর উপর নিপীড়ন-নির্যাতন সীমাহীন মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সেনা-বিজিবি-পুলিশ কর্তৃক জনসংহতি সমিতির অফিস তল্লাশী ও ভাঙচুর, সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতার, তাদের ঘরবাড়ি তল্লাসী ও তছনছ, জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের তালিকা ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করা ইত্যাদি তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত জনসংহতি সমিতির সদস্যসহ ১৫০ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের, নিরীহ গ্রামবাসী ও জনসংহতি সমিতির সদস্য-সমর্থক ৫০ জনকে গ্রেফতার, শতাধিক ব্যক্তিকে সাময়িক আটক ও ক্যাম্পে নিয়ে মারধর এবং বান্দরবানে জনসংহতি সমিতির প্রায় দেড় শতাধিক সদস্যকে এলাকাছাড়া করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা ও কে এস মং মারমা, রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যবামং মারমা, নোয়াপতং ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান অংথোয়াইচিং মারমা ও সাবেক চেয়ারম্যান শম্ভু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, বান্দববান সদর উপজেলার ৩৪৭নং মুরুংক্ষ্যং মৌজার হেডম্যান মংপু মারমা প্রমুখ জনপ্রতিনিধি ও প্রথাগত নেতৃবৃন্দ এলাকাছাড়া অবস্থায় রয়েছেন।
এমতাবস্থায় অচিরেই কোন গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতীত গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক জামিনে থাকা জুম্ম গ্রামবাসীদের অবৈধভাবে আটক করে সেনা জোনে নিয়ে মারধর ও জেলে প্রেরণের ঘটনা বন্ধ করা এবং আটককৃতদের অচিরেই বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করা; বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়ন ও রক্ষার স্বার্থে, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি দমনের নামে আইনের অপব্যবহার করে নিরপরাধ মানুষের উপর সেনা-পুলিশী নিপীড়ন বন্ধ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক সকল অস্থায়ী ক্যাম্প ও ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে সেনাশাসন প্রত্যাহার করা এবং অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
mongsai79@gmail.com

Comments