রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই

পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত জমি থেকে গাছের গুঁড়ি সরাচ্ছেন লক্ষ্মীমনি চাকমা ও তাঁর স্ত্রী। ছবিটি রাঙামাটি সদরের সাপছড়ি ইউনিয়নের বোধিপুর এলাকা থেকে গত শুক্রবার তোলা l সুপ্রিয় চাকমাতিন দিকে পাহাড় এক পাশে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক। মধ্যে ছোট-খাট মাঠের সমান ফসলি জমি। দুই মাস আগেও যেখানে আমন ধানের বীজতলা ছিল, এখন সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পাহাড়ধসের মাটি, গাছের গুঁড়ি ও পাথর। গত ১৩ জুনের পাহাড়ধসে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ধানের জমি। সেই জমি থেকে মাটি ও পাথর সরানোর কাজ করছিলেন কৃষক লক্ষ্মীমনি চাকমা ও তাঁর স্ত্রী লিমামা চাকমা। এক সপ্তাহ ধরেই চলছে তাঁদের এই কর্মযজ্ঞ।
রাঙামাটির সদর উপজেলার সাপছড়ি ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা বোধিপুরে লক্ষ্মীমনি চাকমার এক একর জমি রয়েছে। সব না হলেও জমির কিছু অংশ উদ্ধার করতে চান তিনি। তাঁর তিন মেয়ের সবাই লেখাপড়া করে। সংসারে পাঁচজন মানুষ। জমি চাষ করে পরিবারের সারা বছরের খরচ চালান তিনি। গত বছর ৫০ মণের মতো ধান পেয়েছিলেন। কিছু নিজেদের জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করেছেন। এ বছর আমন মৌসুমে এমন ধাক্কা খেয়ে তিনি দিশেহারা। তবে হাল ছাড়েননি। স্ত্রীকে নিয়ে চলছে হাড়ভাঙা খাটুনি।
সাপছড়ি ইউনিয়নের সাপছড়ি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হারুন রশিদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ব্লকে ৩০৭ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ২১২ একর সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এসব জমিতে আগামী দুই-তিন বছরে কোনো কিছু চাষ করা যাবে না। তারপরও অনেক কৃষক জমি থেকে ধ্বংসস্তূপ সরানোর চেষ্টা করছে। ধ্বংসস্তূপ সরানোর পর চাষ করলেও তেমন ফলন হবে না। কারণ জমির মাটিগুলো পাথর ও বালু মিশ্রিত।
পাহাড়ধসে রাঙামাটির সদর উপজেলার সাপছড়ি, কুতুকছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলা এবং কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের বহু কৃষকের ফসলি জমি মাটি চাপা পড়েছে। আমন চাষের ভরা মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা লক্ষ্মীমনি চাকমার মতোই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। গত কয়েক দিন সাপছড়ি ও কুতুকছড়ি এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
পাহাড়ধসে ফসলি জমির ক্ষতির পুরো চিত্র এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে মিলেছে রাঙামাটি সদর উপজেলা ও কাপ্তাই উপজেলার ক্ষতির হিসাব। এই দুই উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলা সদরের সাপছড়ি-কুতুকছড়ি ও কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের ১ হাজার ৬৪৭ একর কৃষিজমি রয়েছে। এর মধ্যে ৬৫০ একর জমি পাহাড়ধসে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি ৯৯৭ একরের মধ্যে প্রায় ৩০০ একরের বেশি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্পূর্ণ ক্ষতি হওয়া জমিতে আগামী চার থেকে ছয় বছর কোনো কিছু চাষ করা যাবে না। এসব জমিতে আমনসহ বিভিন্ন সবজি চাষ হতো।
রাঙামাটি জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক কৃষ্ণ প্রসাদ মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, পুরো জেলায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কাপ্তাই, সদর, নানিয়ারচর, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলায়। এসব এলাকার ২০ শতাংশ জমি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব জমি চাষের আওতায় আনতে ছয়-সাত বছর লেগে যেতে পারে। সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
জেলার কৃষকেরা বলছেন, অন্যান্য বছর এ সময়ে আমন চারা রোপণ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলে অধিকাংশ চাষযোগ্য জমিতে বালু ও পাথর জমেছে। ফসলের পরিচর্যার বদলে তাই ধ্বংসস্তূপ সরানোয় ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে তাঁদের।
কাপ্তাই ওয়াগ্গা ইউনিয়নের মুরালিপাড়ার বেশ কিছু এলাকায় জমি থেকে ধ্বংসস্তূপ সরানো হচ্ছে। কৃষক মাচানু মারমা বলেন, তাঁদের দুই একর জমিতে বালু, মাটি ও পাথর জমেছে। এর মধ্যে এক একর জমিতে আগামী কয়েক বছর চাষ করা যাবে না। তবে যতটুকু পারা যায় ততটুকু জমিতে এবার চাষ করব।
রাঙামাটি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আপ্রু মারমা প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলে ফসলের জমির ক্ষতি আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরেও পূরণ করা যাবে না। পাহাড়ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য সংস্থা যথেষ্ট সহায়তা করেছে। কিন্তু যাঁদের কৃষিজমির ক্ষতি হয়েছে তাঁরা এ পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাননি।
mongsai79@gmail.com

Comments