জুম চাষ’ বন্ধের নামে আদিবাসী পাহাড়িদের হাত থেকে পাহাড় রক্ষার ভাবনা!! কতটা যৌক্তিক??

Image result for bangladesh hill imageধানি জমির অভাবে প্রায় সব সম্প্র্রদায়ের পার্বত্য আদিবাসীদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল পাহাড়ে উপযোগী জুম চাষ। পাহাড়ে ফসল ফলানোর জন্য জুম চাষ খুবই উপযোগী পদ্ধতি। যুগ যুগ ধরে আদিবাসীরা এ পদ্ধতিতে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তবে জুম চাষকে বর্তমানে বিতর্কিত করা হয়েছে। জুম চাষ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হিসেবে কিছু কিছু সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে। বিশেষ করে বন বিভাগের পক্ষ থেকে অনেক আগে জুম চাষকে বেআইনি ঘোষণার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু আসলেই কি জুম চাষ পরিবেশবান্ধব নয়?
জুম চাষ কি?
জুম চাষ হচ্ছে পাহাড়ের ঢালে এক বিশেষ ধরণের চাষাবাদ পদ্ধতি। পাহাড়ি মানুষের ঐতিহ্যবাহি এই ‘জুম’ শব্দটি থেকে চাকমা ভাষায় ‘জুমিয়া’ (জুম চাষী) ও জুম্ম (পাহাড়ি জনজাতি) শব্দটির উৎপত্তি। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান-এই তিন জেলা নিয়ে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ পাহাড়িই জুম চাষী। এ দেশের পাহাড় ও বনাঞ্চল হচ্ছে সরকারি খাস জমি। যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় সেখানে বসবাসরত পাহাড় ও অরণ্যচারী মানুষের এ সব জমির বন্দোবস্ত কোনো সরকারের আমলেই দেওয়া হয়নি। তাই পাহাড় ও বনাঞ্চলের ওপর আদিবাসী মানুষের এখনো কার্যত জন্মেনি কোনো অধিকার। এক সময় নেত্রকোনা ও শেরপুর অঞ্চলের গারো পাহাড়ে মান্দি (গারো) ও হাজং এবং শ্রীপুর, কুলাউড়া ও মৌলভীবাজার সীমান্তের খাসিয়া পাহাড়ে খাসি বা খাসিয়ারাও জুম চাষ করতেন। কিন্তু প্রায় একশ বছর আগে বৃটিশ আমলে বন বিভাগ গারো পাহাড় এবং মধুপুর-গাজীপুর ভাওয়াল গড় এলাকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল (রিজার্ভ ফরেস্ট) হিসেবে ঘোষণা করে। একই সঙ্গে তারা বন ও পরিবেশ সংরক্ষণের নামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জুম চাষ ও শিকার। এ কারণে গারো পাহাড়ে জুম চাষ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খাসিয়া পাহাড়েও সাধারণ জুম চাষ অনেক আগেই বিলুপ্ত। তবে নানা প্রতিকূলতার ভেতরেও খাসিয়ারা পানজুম চাষ করছেন। এদিকে ১৯৬২ সালে বন বিভাগ রাঙামাটিতে সদর দফতর করে কৃষি প্রধান অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘জুম নিয়ন্ত্রন প্রকল্প’ চালু করে। এর উদ্দেশ্য ছিলো, জুমিয়াদের জুম চাষে নিরুৎসাহিত করে সমতলের জমিতে বনজ ও ফলজ চাষে তাদের উৎসাহিত করা। এক দশক আগেও বন বিভাগের এই প্রকল্প খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হতো। কিন্তু বাস্তবতার কারণেই এই প্রকল্প কখনোই সফল হয়নি। এখন এই প্রকল্পখাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দও নেই।
জুম চাষ কি পরিবেশ বান্ধব?
বহিরাগতদের অব্যাহত জনসংখ্যার চাপ, জুমের জমি সংকুচিত ও পাহাড়ের উর্বরতা নষ্ট হওয়া, বিকল্প আয়ের অভাব, চার দশক ধরে জুম নিয়ন্ত্রনের নামে বন বিভাগের মিথ্যে মামলাসহ নানা হয়রানী — এসব কারণে অর্থনৈতিকভাবে মার খেতে খেতে প্রান্তিক চাষী জুমিয়াদের জীবন এখন বড়ই বিপন্ন। এছাড়া জুম নিয়ে জনমনে তো বটেই, এমন কি সরকারি মহলে রয়েছে নানা ভ্রান্ত ধারণা। এরমধ্যে জুমের আগুনে পাহাড়ের বনজ ও প্রানীজ সম্পদ ধ্বংস, জুমের কারণে পাহাড়ের ভূমি ক্ষয় বৃদ্ধি, জুম একটি পরিবেশ বিরুদ্ধ অবৈজ্ঞানিক চাষ পদ্ধতি — ইত্যাদি প্রধান।
জুম চাষের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক হচ্ছে জুমে কোন সার বা কীটনাশক ব্যবহৃত হয় না। পুড়ে যাওয়া ঝোপঝাড়ের ছাই কীটনাশক ও সারের কাজ করে, সার ব্যবহৃত হলেও তা জৈবিক সার। তাই জুমে উৎপাদিত সব ফসল অর্গ্যানিক ক্রপ হিসেবে বিশ্বের সবখানে সমাদৃত হতে পারে। এক সময় জুম চাষ পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল। এক একটি পাহাড়ের জুম থেকে এক আদিবাসী পরিবারের সারা বছরের খাদ্য নিরাপত্তা থাকে। কিন্তু আদিবাসীদের চিরাচরিত জুম চাষের বিরুদ্ধে কিছু মনগড়া অভিযোগ নিয়ে আসা হয়েছে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে জুম চাষের আগে জঙ্গল আগুনে পোড়ানোর ফলে অনেক বনসম্পদ পুড়ে যায়, মাটি ক্ষয়ে নদীতে পলি জমে, বৃক্ষহীন হয়ে ছোট ছড়ানদীগুলো মরে যায়।
এছাড়াও দেখা গেছে, প্রকৃতির সন্তান জুমিয়ারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই জুমের আগুনে কখনো আগাছা বাদে কোনো বনজ বা প্রাণীজ সম্পদ নষ্ট করে না। তদুপরি জুম চাষে লাঙ্গল বা কোদাল ব্যবহৃত হয় না। জুমিয়ারা পাহাড়ে একটি ছোট্ট গর্ত খুঁড়ে একই গর্তে নানা রকম বীজ এক সঙ্গে বপন করেন বলে ভূমি ক্ষয় হওয়ারও প্রশ্ন আসে না।
বড় বড় গাছের আধিক্য থাকলে সেসব পাহাড়ে জুম চাষ কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ বড় বড় গাছ কেটে পুড়ে ফেলা বা সরানো দুর্গম পাহাড়ে কোনভাবেই সম্ভব নয়। বনের যা কিছু কেটে পোড়ানো হয়, সেগুলো সব ঝোপঝাড়। পাহাড়ে স্থিত বড় বড় গাছ জুমের প্রয়োজনেই রাখতে হয়। প্রকৃতি বিরূপ হলে বৃষ্টিপাত কম হয় এবং সেই খরা থেকে জুমকে বাঁচাতে প্রয়োজন হয় চা-বাগানের মতো ছায়াদাতা বড় বড় গাছের। বনজসম্পদ পুড়ে যাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। যেটুকু পুড়িয়ে ফেলা হয়, তার অনেকগুণ বেশি ফসলে ভরে ওঠে জুমপাহাড়। ঝোপঝাড় পোড়ানোর দু’এক মাসের মধ্যে আবার সবুজে ভরে যায় পাহাড়। ফসল তোলার পর উর্বর হওয়া পাহাড় প্রাকৃতিক বনে ভরে যায়। পরবর্তী তিন-চার বছর সেখানে জুম চাষ করা হয় না। পাহাড়ে বন ছাড়া ফসলের চাষ করা না গেলে সমভূমিতেও বন ছাড়া অন্য কিছু চাষ করা যাবে না বলা সমীচীন হবে কি? জুম চাষের ফলে মাটি ক্ষয় হওয়ার বিষয়টিও সঠিক নয়। জুম চাষ সমভূমির চাষের মতো নয়। সমভূমিতে মাটি কর্ষণ করে জমি তৈরি করতে হয়। কিন্তু জুম চাষে মাটি থাকে সম্পূর্ণ অকৃষ্ট, দায়ের মাথা দ্বারা ছোট এক কোপ দিয়ে ছিদ্রমতন যে গর্ত হয় তাতে ধানসহ বিভিন্ন বীজ রোপণ করা হয়। আর শাকসবজির বীজ ছিটানোর মাধ্যমে চাষ করতে হয়। ফলে বৃষ্টি হলেও মাটি ক্ষয় হয় না। আদিকাল থেকে এখনও আদিবাসীরা জুম চাষ করে আসছে। কোনদিন জুমে ভূমিধস হয়েছে বা ভূমিধসে মানুষ মারা যাওয়ার খবর শোনা যায়নি। তাছাড়া জুমে আদিবাসীরা মাটি কেটে বাসা বানায় না, টংঘর তৈরি করে বসবাস করে। তাতে পাহাড় অক্ষত থাকে। কাজেই জুম চাষের ফলে মাটি ক্ষয়ের অভিযোগ সঠিক নয়। জুম চাষের কারণে জুমপাহাড় সংলগ্ন কোন ছড়ানদী শুকিয়ে যাওয়ারও নজির নেই। জুমপাহাড় বৃক্ষশূন্য হয় না। কারণ জুমপাহাড়ের পাদদেশের কোন গাছ কাটা হয় না। ফলে ওয়াটারশেড ম্যানেজমেন্ট প্রাকৃতিকভাবে কার্যকর থাকে।
পাহাড় ধ্বস- ভূমি ক্ষয়ের প্রকৃত কারণ কি?
নির্বিচারে গাছগাছালি আর পাহাড় ধ্বংস করা, পাহাড় ইজারা দেওয়া, পাহাড়ের গাছপালা কেটে সাবাড় করা, বাড়িঘর বানিয়ে গরীব মানুষদের ভাড়া দেওয়া, যথেচ্ছ পাহাড় কেটে পর্যটন স্পট বানানো এইগুলিই মূলত পাহাড় ধসের কারন। আর এসব কাজ এক শ্রেণীর ভূমিখেকো, পাহাড়খেকো করে আসছে। আর তাদের ক্ষমতার উৎস যে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী তা আর বলে দিতে হয় না। এখন পাহাড়ে অপরিকল্পিত নির্মাণ ও পাহাড় কাটার ফলে ভূমি ক্ষয় তথা পাহাড় ধ্বসের হার অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশী। পাঁচ-ছয় দশক আগেও একবার কোনো পাহাড়ে জুম চাষ করার পর অন্তত ১৫-২০ বছর সেখানে আর জুম করা হতো না। সেখানে এই দীর্ঘ সময়ে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল গড়ে ওঠার সুযোগ দেয়া হতো; রক্ষা পেতো পাহাড়ি জমির উর্বরতা। কিন্তু জনসংখ্যার চাপে জুমের জমি কমতে থাকায় অন্তত পাহাড়গুলোকে ১৫ — ২০ বছর অনাবাদী রাখা হচ্ছে না বলে প্রাকৃতিক বনের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাষযোগ্য সমতলভূমির সংখ্যা খুবই কম বলে পাহাড়ে জুম চাষের বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি।
জুম চাষ কেন কমে যাচ্ছে?
ষাটের দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করে প্রথম আঘাত হানা হয় বনাঞ্চলের ওপর। এই বাঁধের কারণে প্রায় ৫৪ হাজার একর জমি পানিতে তলিয়ে যায় বলে চাষের জমিও হয়ে পড়ে সংকুচিত। আর ৮০ র দশক থেকে এখনো পাহাড়ে সমতল অঞ্চল থেকে অপরিকল্পিতভাবে বাঙালিদের অভিবাসন গড়ে উঠছে। এছাড়া বন বিভাগসহ নিরাপত্তা বাহিনীর অসংখ্য স্থায়ী এবং অস্থায়ী ছাউনির কারণেও বিপুল সংখ্যক পাহাড় ও বনাঞ্চল অধিগ্রহণ করা হয়েছে এমনিভাবে দিন দিন জনসংখ্যার চাপে ও বন বিভাগের নানা নিয়ম-কানুনের ফলে সংকুচিত হচ্ছে জুমের জমি। তাই জুমিয়ারা অনেক জায়গাতেই এখন বাধ্য হয়ে মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ব্যবধানে একই পাহাড়ে আবারো জুম চাষ করছে। এতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে পাহাড়ের উর্বরতাও। তাই বিচ্ছিন্নভাবে অনেক জুমিয়া এখন চাষের জমিতে ধুপ সার বা ইউরিয়া ব্যবহার করছেন; যা আগে কখনোই দেখা যায়নি।
এছাড়া শান্তিচুক্তির (১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়) যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি বলে পাহাড়ে এখনো হয়নি ব্যাপক ও বড় ধরণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আড়াই দশকের অশান্ত পাহাড়ে কৃষির বিকল্প কোনো আয়ের ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। তাই ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে জুম চাষ করছে। বলা ভালো, জুম চাষীরা হচ্ছেন সকলেই প্রান্তিক চাষী ও সাধারণতভাবে হত দরিদ্র। তাই জুম চাষ করা ছাড়া অন্য কোনোভাবেই তাদের টিকে থাকার উপায় নেই। অন্যদিকে বহুবছর ধরে পাহাড়ে কল-কারখানা গড়ে না ওঠায় সৃষ্টি হয়নি বিকল্প আয়ের পথ।
জুম চাষের ভবিষ্যৎ কি?
পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষের এই বিজ্ঞান সম্মত চাষাবাদ নানা দেশেই প্রচলিত। এসব দেশের তুলনায় আমাদের দেশের পাহাড়গুলো অনেক উর্বর। আমাদের জুম চাষীরা শত শত বছর ধরে শুধুমাত্র প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে ফলিয়ে আসছেন পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ফসল, শাক-সব্জি, ফল-মূল। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এখন তারা জুমের জমিতে ব্যবহার করছেন রাসায়নিক সার।
যে ভাবে পাহাড়ে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে, ভবিষ্যতে এখানে হয়তো আর জুম চাষ সম্ভব হবে না। প্রায় সাত লাখ ভূমিহীন এসব জুম চাষীদের এখনই পুনর্বাসনের জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। এ জন্য প্রাথমিকভাবে তাদের কিছু অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে এবং হর্টিকালচার, ফিসারিজ, কি ছোট ছোট প্রকল্প খাতে সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে পুনর্বাসন করা জরুরি।
mongsai79@gmail.com

Comments