পাহাড়ে সুশিক্ষার ফেরিওয়ালা ত্রিপুরা মেয়ে

পাহাড়ে সুশিক্ষার ফেরিওয়ালা
... শোভা রানী ত্রিপুরার জন্ম রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলায়। তাঁর স্বামী মংছেনচীং সাহিত্যে ২০১৬ সালে একুশে পদক পান। ওই বছর শোভা রানীও উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ হিসেবে পুরস্কৃত হন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা আর লেখালেখিতে মগ্ন থাকেন তিনি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ছাড়াও সমাজের নানা বিষয়-আশয় ওঠে আসে তাঁর লেখায় ...

কবি ও কথাসাহিত্যিক শোভা রানী ত্রিপুরা। পেশায় শিক্ষক। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন কোমলমতি শিশুদের মাঝে। শিক্ষকতার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা আর লেখালেখিতে তাঁর বিশেষ আগ্রহ। শৈশব-কৈশোর থেকে লেখালেখির অভ্যাস। ছোট বয়সে লেখায় হাতেখড়ি। শোভা ত্রিপুরা নিজ জনগোষ্ঠীর একজন উদ্যমী নারী।
ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ছাড়াও তিনি লিখেছেন ছোটগল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী, গান, উপন্যাস ইত্যাদি। ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠেছে লেখালেখি। প্রাণ হয়ে ওঠেছে সাহিত্যচর্চা। তিনি ‘কথাসাহিত্য’ আর ‘লোকসাহিত্য’ তুলে ধরেন মন দিয়ে। লেখালেখির জন্য একজন মানুষের যে ব্যাকুলতা দরকার, সবটুকু লালন করেন এই নারী।
১৯৮৪ সালে আরেক লেখক ও গবেষক মংছেনচীং রাখাইন (মংছিন) এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শোভা ত্রিপুরা। পেলেন লেখক সঙ্গী। শুরু হয় নতুন যাত্রা। এর আগেই শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন। এভাবে লেখক শোভা ত্রিপুরার এগিয়ে চলা শুরু। কেবল লেখালেখি করেন তাই নয়, সমাজসেবায়ও শোভা রানীর আছে ভূমিকা। জীবনের প্রথমদিকে নিজে গিয়ে দৈনিক গিরিদর্পণ আর দৈনিক অরণ্যবার্তায় লেখা দিয়ে আসতেন। ডাকঘরের মাধ্যমেও লেখা পাঠাতেন। এ দুটি দৈনিক ছাড়াও রাঙামাটি থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বনভূমি’ পত্রিকায় বহু কবিতা, ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে দেশ-বিদেশের কয়েকটি পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে তাঁর কয়েকটি লেখা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর বিভিন্ন লেখায় পাহাড়ি জনজীবনের কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে সমতলের মানুষের জীবনযাত্রার কথাও।
এ যাবত তাঁর প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে, ঝরাপাতা (কবিতা) ১৯৯৬, ত্রিপুরা জাতির ইতিকথা ২০০১, ত্রিপুরা জাতির রূপকথা ২০০২, জাতক (বুদ্ধ) ২০০৪, ত্রিপুরা জাতি ২০০৭, ত্রিপুরা জাতির ইতিবৃত্ত, আলোময়ীমা ত্রিপুরেশ্বরী, শুভ বাংলা নববর্ষ ২০১২, স্বপ্নের ধূসর ছায়া (গল্প) ২০১৩, ‘রাখাইন ও ত্রিপুরা জাতিসত্তা’ ২০১৪, ধূসর পাহাড়ে সবুজ তারুণ্য (গল্প) ২০১৪, ত্রিপুরা জাতির কিংবদন্তী ২০১৪, একুশের অপরাজিত কথামালা (নাটক) ২০১৪, গিরি নন্দিনী (কবিতা) ২০১৪ ও আলোক নবগ্রহ ধাতু চৈত্য বৌদ্ধ বিহার ও ভদন্ত চন্দ্রমণি মহাথেরো প্রভৃতি। শোভা ত্রিপুরার সাহিত্য কর্মের বেশি অংশ জুড়ে নিজ জাতি-ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, ইতিহাস স্থান পেয়েছে। তাছাড়া বৌদ্ধ ধর্ম ও জাতক, রাখাইন জীবনধারা ইত্যাদি নিয়েও কাজ রয়েছে তাঁর।
বাবার চাকরি সূত্রে শোভা ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়িতে বসবাস করেন। ১৯৭৭ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে প্রথমবর্ষে পড়া অবস্থায় শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন। এখনো শিক্ষকতায় নিয়োজিত তিনি। জেলার মহালছড়ি চৌংড়াছড়িমুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিনি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অবসরে যাওয়ার কথা তাঁর। শোভা ত্রিপুরা জানালেন, কেবল পুঁথিগত শিক্ষা নয়; শিক্ষার্থীদের জীবনমুখী শিক্ষা দেয়াই তাঁর কাজ। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিল্প, সাহিত্যবোধ আর জীবনগঠনের জন্যে যথার্থ মূল্যবোধ বিষয়টিকে তিনি সবসময় গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। শুধু শিক্ষার্থীদের এমন শিক্ষা দিচ্ছেন তা নয়, নিজের দুই কন্যা সন্তানকেও সঠিক পথে নিয়ে আসতে পেরেছেন বলে খুব গর্ববোধ করেন শোভা ত্রিপুরা। ‘রত্নগর্ভা’ এই নারীর দুই কন্যা স্ব স্ব মহিমায় ভাস্বর। ছোট কন্যা চেনচেননু জাতীয় রচনা প্রতিযোগিতায় রৌপ্য পদকপ্রাপ্ত। ২০১১ সালে মহালছড়ি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অংশ নিয়ে জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ‘শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক’ হন। বর্তমানে শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি অনার্স (চতুর্থ বর্ষ) করছে। বড় কন্যা প্রিয়াংকা পুতুল রাঙামাটি সদর শুকছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা পদে কর্মরত।
শোভা ত্রিপুরা ১৯৭৩ সালে বঙ্গভবনে কৃতী যুব সংবর্ধনায় অংশ নেন। ১৯৯৯ সালে ঢাকা নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা আয়োজিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলার লেখিকা হিসেবে সংবর্ধিত হন। ১৯১২ সালে মহান স্বাধীনতা দিবসে মহালছড়ি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ কর্তৃক সাহিত্যে অবদানের জন্য ‘সংবর্ধনা’ প্রদান করা হয় তাঁকে। শিক্ষকতায় উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে তিনবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। কবি ও কথাসাহিত্যিক শোভা ত্রিপুরা বাংলাদেশ ত্রিপুরা জাতির মসী চালনায় ‘অগ্নিকন্যা খেতাব’ প্রাপ্ত হন। সামাজিক অনেক কাজে জড়িত শোভা ত্রিপুরা। মহালছড়ি শিল্পকলা একাডেমির সদস্য তিনি। জাতীয় মহিলা সংস্থা, রাখাইন-ত্রিপুরা প্রকাশনা সমিতি, বিশ্ববাংলা সাহিত্য পরিষদ, ছায়ানীড় এর সাথেও সম্পৃক্ত।
১৯৮১ সালে ‘বনভূমি সাহিত্য পুরস্কার’, ১৯৮০ ও ১৯৮৫ সালে রাঙামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট হতে রূপকথা পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ আদিবাসী কবি পরিষদ ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ হতে কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ‘সম্মাননা সনদ’, ঢাকায় ‘ছায়ানীড় স্মারক সম্মাননা’, বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসে সাহিত্য সংস্কৃতি উৎসব-এর ‘রাহিলা সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি সভাঘর কর্তৃক আঞ্চলিক ভাষা ও কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ‘কবি নজরুল স্মারক সম্মাননা ২০১৪’ প্রদান করা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ হিসেবে পুরস্কৃত হন। বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি কেন্দ্রে কথিকা লেখক ও পাঠক শোভা ত্রিপুরা ১৯৫৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি জেলার বরকলে জন্মগ্রহণ করেন। স্বামী মংছেনচীং (মংছিন) পেশায় মুক্ত সাংবাদিক। তিনি সাহিত্য রচনা ছাড়াও গবেষণামূলক কাজ করে থাকেন। মানবাধিকার কর্মীও তিনি। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে সরকার মংছেনচীংকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
mongsai79@gmail.com

Comments