গলার কাঁটা রোহিঙ্গা

গলার কাঁটা রোহিঙ্গা

মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এখন বিষফোঁড়ার মতো হয়ে উঠেছে। কক্সবাজারে দিনে দিনে বাড়ছে অনুপ্রবেশকারীর বোঝা। রোহিঙ্গারা ছলে-বলে-কৌশলে ভোটার তালিকাভুক্ত হচ্ছে। অনেকে ইউনিয়ন পরিষদের নিবন্ধনও জোগাড় করে নিচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভুয়া নিবন্ধনে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করছে। এমনকি কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলেজ স্থাপনেরও চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র হাতিয়ে নিয়ে পাসপোর্ট বানিয়ে বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয়ে পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে এসব সমস্যা-সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে কেবল মিয়ানমারের বার্মিজ ভাষা এবং আরবি ভাষায় লেখাপড়া শেখানোর কথা থাকলেও শিবিরে কর্মরত এনজিওগুলো কৌশলে বাংলাকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে ৫৫টি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছেন ১৩৪ জন শিক্ষক।
ইউনিসেফের সহযোগিতায় ‘মুক্তি’ নামের কক্সবাজারের একটি বেসরকারি সংস্থা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাকেই প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
কুতুপালং অনিবন্ধিত শিবির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুর গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা পড়ানোর জন্য শিক্ষক রয়েছেন ১২৫ জন। আর বার্মিজ ভাষার শিক্ষক
আছেন মাত্র ৯ জন। তাই সেখানে বাংলাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। ’
রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতীয় কৌশলপত্র নিরূপণের জন্য গঠিত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যরা গত ২৩ আগস্ট রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যরা শিবিরে বাংলা লেখাপড়াকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করবেন বলেও সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তা ও সংবাদকর্মীদের জানান।
অভিযোগ রয়েছে, কিছু মহল হীন রাজনৈতিক স্বার্থে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় শুধু নয়, বাংলাদেশি বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সাবেক শিবির নেতা, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং বর্তমানে বিএনপি নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে ২০ জন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাকে জাতীয়তা সনদ ও ১০টি নিবন্ধন সনদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোহাম্মদ আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে এ অভিযোগ দেওয়া হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এ ব্যাপারে তদন্তের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ইউপি চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে বলেন, এসব ভুলক্রমে দেওয়া হয়েছিল।
কক্সবাজার ও চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যেও রোহিঙ্গারা প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। এ ক্ষেত্রে তারা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কয়েকটি দেশসহ পাকিস্তানে অবস্থানরত রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত লোকজনের সহযোগিতা পেয়ে আসছে। এসব রোহিঙ্গার একটি বড় অংশ মিয়ানমারে উত্পাদিত মরণনেশার ট্যাবলেট ইয়াবা পাচারের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের পর অন্যত্র বিনিয়োগ করে থাকে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বড় বড় পাইকারি দোকান থেকে শুরু করে স্থানীয়দের সঙ্গে পার্টনারশিপের মাধ্যমে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলছে রোহিঙ্গারা।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের হুন্ডি ব্যবসার বেশির ভাগই রোহিঙ্গাদের দখলে। এমনকি পরিবহন ব্যবসায়ও ঢুকে পড়েছে তারা। রোহিঙ্গা জঙ্গি বিদ্রোহী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) একজন সক্রিয় সদস্য কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস নামিয়েও ব্যবসা করে যাচ্ছেন। মোহাম্মদ হোসাইন কেরানী নামের এই আরএসও সদস্য কয়েক কোটি টাকার মালিক কিভাবে হলেন, তা নিয়েও রয়েছে নানা গুঞ্জন।
মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, দুবাইসহ আরো কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে রয়েছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে সাগরপথে বিশ্বজুড়ে আলোচিত মানবপাচারের যে ঘটনা ঘটেছিল, এসবের নেপথ্যেও জড়িত ছিল রোহিঙ্গারা। পরে মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশি ভিকটিমদের মুখে রোহিঙ্গাদের নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়াল কাহিনির কথা এখনো ভুলতে পারছে না স্থানীয়রা।
অনুরূপ সৌদি আরবেই রয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে সেনাদের নির্যাতনের শিকারকে স্রেফ পুঁজি করে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গারা সৌদি আরবের কর্তৃপক্ষের কাছে একটি অবস্থান সৃষ্টি করে নিয়েছে। এর জোরে রোহিঙ্গারা সৌদি আরবের বাংলাদেশিদের ওপর কথায় কথায় চড়াও হয়ে থাকে বলে খবর রয়েছে।
কক্সবাজার ও বান্দরবানে অবস্থানরত অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো উপায়ে দ্রুত টাকা আয়ের পথ বেছে নেয়।
শফিকুর রহমান ওরফে আবদুর রহমান নামের এক মানবপাচারকারী ও হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত রোহিঙ্গা রাতারাতি কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা মৌলভীপাড়ায় জমি কিনে বাড়ি করে আলোচনায় উঠে এসেছেন। কক্সবাজার শহরের তারাবনিয়া ছড়া এলাকায় মৌলভি আয়াছ নামের আরেক রোহিঙ্গা বহুতল ভবন নির্মাণ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। কক্সবাজার সিটি কলেজসংলগ্ন দক্ষিণ পাশে আরো একজন চোরাকারবারি রোহিঙ্গার আলিশান ঘরও বেশ আলোচিত।
শুক্রবার রাতে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে কক্সবাজারের সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সত্যিই সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের এখন যে রমরমা অবস্থা চলছে তাতে আমরা স্থানীয়রা বেশ উদ্বিগ্ন। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমরাই সংখ্যালঘু হয়ে যাব। ’ সভায় মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের এমপি আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, রোহিঙ্গাদের পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তি কাজ করছে। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের চাপ অনেক সহ্য করেছি। আর সহ্য করব না। বর্তমানে পাঁচ-ছয় লাখ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা অবস্থান করছে দেশে। অথচ আমাদের দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রায় চাল আমদানি করতে হচ্ছে। সেই বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করা চাল আমরা রোহিঙ্গাদের খাওয়াতে পারি না। ’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. এ কে এম ইকবাল হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণেই প্রতিনিয়ত আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে আমাদের উত্কণ্ঠায় থাকতে হয়। প্রায় প্রতিটি অপরাধজনক ঘটনায় কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকে রোহিঙ্গারা। ’ কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, কক্সবাজারের দায়রা জজ এবং বিশেষ আদালতে বিচারাধীন হত্যা ও ইয়াবা পাচারের মামলাগুলোর বেশির ভাগেই আসামি হিসেবে রয়েছে রোহিঙ্গারা।
কক্সবাজারের টেকনাফের লেদা, নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও তাদের কর্মকাণ্ডে বনজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে রোহিঙ্গারা বন বিভাগের জমির ওপর বৈধ ক্যাম্পে বসবাস করে আসছে। এরপর গত বছরের ১১ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা টেকনাফ, উখিয়ার বালুখালী, কুতুপালং এলাকায় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার একর বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গারা তাদের সুবিধার্থে নির্বিচারে পাহাড় কাটছে। বন রেঞ্জ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পর্যায়ের সরকারি লোকজন জানান, যত্রতত্র বনভূমি দখল করে নির্মিত ঝুপড়ি উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে রোহিঙ্গারা বনকর্মীদের ওপর চড়াও হয়। এ রকম ঘটনায় রোহিঙ্গাদের আসামি করে উখিয়া থানায় একটি মামলাও করেছে বন বিভাগ।
টেকনাফ বন বিটের কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, বেশ কয়েকবার উচ্ছেদ করা হলেও একশ্রেণির দালাল এদের আবারও বনভূমি দখলে সহায়তা করে থাকে। হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান জানান, রোহিঙ্গারা এমনকি সামাজিক বনায়নের বাগানও সাবাড় করে ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশ বিপর্যয়ের বেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এসব এলাকা।
সম্প্রতি টেকনাফের লেদা, বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রোহিঙ্গা বস্তির আড়ালে নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। কয়েকজন রোহিঙ্গা জানায়, তারা ঝুপড়ি নির্মাণের জন্য বনভূমির পরিত্যক্ত জায়গা সংস্কার করে বসবাসের উপযোগী করে তুলছে।
কুতুপালং বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক জানান, নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের পাহাড় কাটা থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হয়েছে। তবে স্থানীয় কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী পাহাড় কেটে গরিব রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে। এ নিয়ে মইগ্যা নামের এক রোহিঙ্গার সঙ্গে পিতা-পুত্রের সংঘর্ষও হয়েছে।
শরণার্থী ক্যাম্পগুলো পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসীদেরও নিরাপদ আস্তানায়। একসঙ্গে কয়েকটি গ্রুপ আশ্রয় নেওয়ায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছে। সম্প্রতি এক-দেড় মাসের ব্যবধানে ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানকারী সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে অপহূত টেকনাফ, নয়াপাড়া, উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাঁচ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। অপহূত ও আহত হয়েছে আরো শতাধিক। এসব ঘটনার রেশ না কাটতেই দুই সপ্তাহ আগে দিনদুপুরে প্রকাশ্যে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিককে হত্যার লক্ষ্যে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। অপহরণ ও খুনের ভয়ে লেদা, বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিরা অজ্ঞাত স্থানে রাত কাটায় বলেও জানায় অনেকে।
উখিয়া কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক জানান, দুই সপ্তাহ আগে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তির খেলার মাঠ-সংলগ্ন চা দোকানে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। স্থানীয় রোহিঙ্গারা এগিয়ে এলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। আবু ছিদ্দিক চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে কয়েক দিন চিকিত্সাও নিয়েছেন।
মজার মজার ভিডিও দেখতে নিচে লিংকের ক্লিপ করুণ https://www.youtube.com/channel/UCDUgcFp1WTEUfSzViR9tozA

Comments