বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর বেহাল দশা

 শিক্ষকদের ক্রমাগত অনুপস্থিতি, অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, পাঠদানে চরম দায়িত্ব অবহেলা, ক্লাস শুরু হতে না হতেই ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে বিদ্যালয়ের দিনলিপি শেষ করা বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন চিত্র।
শিশুদের মেধা যাচাইয়ের এবং বিকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই প্রাথমিক স্তরে দুর্গম অঞ্চলের পাহাড়ী শিশুরা মেধা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে এবং অকালে ঝড়ে যাচ্ছে। শিক্ষাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের অতি দুর্গম এলাকায় অবস্থিত রামথুই পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।

১৯৬৬ সালে প্রতিষ্টা লাভের পর ১৯৭৩ সালে রামথুই পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে একজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ ৩ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। শিক্ষক ও শ্রেণী কক্ষ সংকট থাকা সত্বেও দুর্গমত্তার কথা বিবেচনা করে বিদ্যালয়টি নিন্মমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নিত করার লক্ষ্যে চলতি ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেনীর পাঠদান শুরু করা হয়। মরার উপর খাড়ার ঘা এখন বিষ ফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুল আলোচিত এই বিদ্যা পিঠটি। ত্রিশ ডেবা পাড়ার ১৬০ পরিবারের দেড় শতাধিক মারমা সম্প্রদায়ের শিশু এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

ত্রিশ ডেবা পাড়ার প্রাক্তন ইউপি মেম্বারসহ অভিবাবকরা এসএমসি কমিটির সদস্য। ১৬ বছর ধরে এসএমসি কমিটির সভাপতি একজনই। তবে সভাপতি ব্যতীত কমিটির বাকী সদস্যরা কমিটি সম্পর্কে ওয়াবিকহাল নয়। ফলে বিদ্যালয়টি চলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের কথাই। ব্যাপক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদ্যালয়টি পরিচালিত হয়ে আসায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এসএমসি কমিটির অপরাপর সদস্য ও অভিবাবকরা।

ত্রিশ ডেবা বৌদ্ধ বিহারের বিহার অধ্যক্ষ পঞাছামি ভিক্ষু বলেন, এসএমসি কমিটি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। সিনিয়র এক শিক্ষক তার কাছে স্বাক্ষর নিতে আসলে তিনি জানতে পারেন তাকেও এসএমসি কমিটিতে রাখা হয়েছে। স্কুলের শিক্ষকদের চরম অবহেলা রয়েছে। তারা পালাক্রমে স্কুল চালায়। শিক্ষকদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে স্কুলের কোন সুনাম এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি কোন শিক্ষক।

এসএমসি কমিটির সদস্য নাই লুং মারমা জানান, শিক্ষকরা আজ একজন আসলে আগামীকাল আরেকজন আসে। এভাবে পালাক্রমে স্কুলে আসে শিক্ষকরা। প্রতিদিন ১০ বা ১১ টায় স্কুলে এসে ১২ টা বা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ক্লাস করে চলে যায় শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপুর্ণ বিষয় গুলো কোন সময় পড়ানো হয় না। ফলে ছাত্রছাত্রীরা মেধা প্রতিযোগিতায় ঠিকতে পারে না এবং শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রামথুই পাড়া স্কুলে প্রাইমারী পাশ করা কোন ছেলে মেয়ে সফল্যের সাথে এসএসসি পাশ করছে তেমন কোন নজির নেই। তাদের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন তারা। এ অবস্থা চলতে থাকলে স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ একেবারে ধংস হয়ে যাবে বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ত্রিশডেবা পাড়া প্রধান কারবারী বলেন, স্কুলের জায়গাটি তিনি দান করেছেন। যাতে ঐ এলাকার শিশুরা শিক্ষার আলো পায়। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কোন সময় পুর্ণাঙ্গ ক্লাস হয়নি। শিক্ষকরা নিজেদের ইচ্ছামত স্কুলে আসে আর যায়। চলতি বছর প্রায় শেষের পথে সামনে বার্ষিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের এখনো কোন প্রস্তুতি নেই। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ধংসকারী এসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানান তিনি।

এসএমসি কমিটির সভাপতি মং ফো চিং মারমা জানান, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তিনি শিক্ষা অফিসারের নিকট কয়েকবার অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের ফলে শিক্ষকদের বেতনও ৩-৪ মাস বন্ধ রাখা হয়। শিক্ষকদের ৩-৪ মাসের বেশী বেতন বন্ধ রাখার কোন বিধান নেই বলে জানান তিনি।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মং য়ই থিং মারমা বলেন, তিনি সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তবে মাসিক সমন্বয়সভা ও বিভিন্ন কাজে তাকে লামা আসা-যাওয়া করতে হয়। এ বছর ৬ষ্ঠ শ্রেনী চালু করা হয়েছে, শিক্ষক ও শ্রেনী কক্ষ অনেক কম থাকায় নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যালয়ে অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে তিনি বলেন, এলাকাবাসীর অভিযোগ সঠিক নয়। কারণ এখানে এত রিমোট এলাকা আসা-যাওয়া করতে জীবনের ঝুকি হয়ে যাচ্ছে। তিনি ঐ এলাকা থেকে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের সেখানে পদায়ন করলে ভাল হবে বলেও মত প্রকাশ করেছেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রিটন কুমার বড়–য়া জানান, দুর্গম স্কুলের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কিছু কিছু অভিযোগ আসে। অভিযোগ গুলোর তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। লামা উপজেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে রামথুই পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনেছি। আগামী ৬ তারিখ তদন্তের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে সেখান থেকে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অন্যতম প্রধান দায়ী হচ্ছে উপজেলা শিক্ষা অফিসার এবং সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার। তাদের সাথে শিক্ষকদের অর্থনৈতিক লেনদেনের সখ্যতা অনেক পুরানো। ফলে এলাকার পক্ষ থেকে হাজারো অভিযোগ আসলে সে অভিযোগ গুলো জেলা পর্যন্ত পৌছায় না।
অভিযোগ গুলো উপজেলার ফাইলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ফলে শিক্ষকরা নানা অনিয়ম ও দুণীর্তিতে জড়িয়ে পড়ে। জেলার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে শিক্ষকদের শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়ার আগে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনকরা জরুরী বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী অভিবাবকরা।
mongsai79@gmail.com

Comments