রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ঢুকে পড়েছে

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ঢুকে পড়েছে
অনুপ কুমার চাকমা
মিয়ানমারের বারবার ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ একবার খুলে দিলেই রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করবে এবং পরে আর কেউ এদের কোনো দায়দায়িত্বই নেবে না। মিয়ানমারে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে আসা মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অনেক ধরনের রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। কেউ না কেউ এখান থেকে স্বার্থ হাসিল করতে চাইছে। শুধু এই এক ইস্যুর কারণেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একে অপরের প্রতিবেশী হয়েও নিজেদের আস্থায় আনতে পারছে না।
অনুপ কুমার চাকমা বলেন, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প বা অফিসে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে অপারেশন চালানো হচ্ছে। এরপর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দিকে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের আসতে দিচ্ছে না। এটাই হলো বর্তমান পরিস্থিতি। তো এমন ঘটনা হলেই বাংলাদেশ তার সীমান্ত খুলে দেবে, এটা কখনোই হতে পারে না। কারণ বারবার এ পরিস্থিতি কেউ তৈরি করছে। কেউ না কেউ এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পেছন থেকে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এ জন্য আন্তর্জাতিক কোনো ইন্ধনের ইঙ্গিত করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, এটা অনস্বীকার্য যে রাখাইন রাজ্যে খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। বাসিন্দা রোহিঙ্গারা এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। যে কোনো সুযোগ পেলেই তারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে চাইবে। বরং প্রবেশে বাধা পেলে ধীরে ধীরে এ প্রবণতা কমে আসবে।
মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা বলেন, ২০১২ সালের পর থেকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনা বেশ খানিকটা কমে এসেছে। সে সময় লাখে লাখে রোহিঙ্গা নৌকায় করে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছিল। পরে দূতাবাসের পক্ষ থেকে অনুপ্রবেশের সুযোগ বন্ধ করার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার নতুন অবস্থানে যায়। এর পরই অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কমে আসে। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠী কাজ করে। ইচ্ছাকৃতভাবে এ ধরনের সহিংস পরিস্থিতি বারবার তৈরি করা হয়। এবারও তেমনটা হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ এবার জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার পরপরই সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু কমিশন তো মোটামুটিভাবে তাদের পক্ষেই সুপারিশ করেছিল। অথচ কমিশনের রিপোর্টের দেড়-দুই ঘণ্টার মধ্যে জ্বালাও-পোড়াও শুরু হলো। এমনটা হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিদেশি অনেক দেশের অনেক ধরনের রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় এ অঞ্চলে স্বার্থান্বেষীরা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টা করছে। ২০১২ সালে সীমান্ত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হয়। তখন পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঢাকার পররাষ্ট্র দফতরে সীমান্ত খুলে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয় থেকে মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়। তখন আমি মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত থাকায় তারা আমার কাছেও আসে। পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সঙ্গে নৈশভোজে আমি সীমান্ত বন্ধ করার পক্ষে যুক্তিগুলো তুলে ধরি। আমি বলেছিলাম, সীমান্ত খুলে দেওয়ার সুপারিশ আমি করব, যদি আপনারা অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব নেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার কথাও তাদের বলি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বারবার মাতৃভূমির বাইরে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বরং নিজ মাতৃভূমিতে রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করলেই পরিস্থিতি উত্তরণ সম্ভব। এর পর থেকে বাংলাদেশের ওপর সেই চাপ কমে এসেছে। লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই ক্যাম্প করে নিরাপত্তা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু গত বছর আবার সহিংসতার কথা বলে খুবই অল্প সময়ে প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। এর পেছনে বড় ধরনের ইন্ধন আছে। তিনি বলেন, বাইরের কোনো শক্তি এ ইন্ধন দিচ্ছে। আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের বাইরে থেকে অন্য কোনো দেশ এসে এর সমাধান করবে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা তো দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করছে। কিন্তু কোনো সমাধান নেই। বরং এটা একটা আন-এন্ডিং প্রসেসে চলে গেছে। আসলেই যারা আলোচনা করছে তারাই সমাধান চায় কি না এটাও ভাবার বিষয়। সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে সব সময়ই সরব দেখা গেছে। কিন্তু তারাও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার দাবিকে তেমনভাবে ফোকাস করছে না। আবার বাংলাদেশের মিডিয়ার ভূমিকাও নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আস্থা নষ্ট করছে। কারণ বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের অভ্যন্তরের, বিশেষত রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ডকে তাদের ভূখণ্ডের জন্য লড়াই বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের মিডিয়া রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। ঢাকার জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন মিয়ানমার দেখছে না এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আর কোনো একটি দেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো গোষ্ঠীর কাজ নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার আমাদের নেই। এসবও বাংলাদেশ-মিয়ানমার আস্থাহীনতার কারণ। তাই রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানও দিন দিন কঠিন হচ্ছে।
মজার মজার ভিডিও দেখতে নিচে লিংকের ক্লিপ করুণ https://www.youtube.com/channel/UCDUgcFp1WTEUfSzViR9tozA

Comments