প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয় মিয়ানমার দূতকে ডেকে ঢাকার উদ্বেগ প্রকাশ

প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয় মিয়ানমার

ঢাকায় মিয়ানমারের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) অং মিন্টকে তলব করে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার খবরের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে সর্বশেষ সহিংসতায় প্রাণহানি এবং আবারও অনুপ্রবেশের চেষ্টায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ বলছে, মিয়ানমারকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলেছে, সমস্যাটি মিয়ানমারের। তাই সমাধান তাদেরই করতে হবে। মিয়ানমারের সিডিএকে গতকাল শনিবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশের এ অবস্থান তুলে ধরেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (এশিয়া ও প্যাসিফিক) মাহবুব উজ জামান।
মিয়ানমারের সিডিএ গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (এশিয়া ও প্যাসিফিক) মাহবুব উজ জামানের সঙ্গে আলোচনা করেন। সচিব এ সময় জানান, গত বছরের অক্টোবরে অনুরূপ এক পরিস্থিতির পর থেকে প্রায় ৮৫ হাজার লোক বাংলাদেশে ঢুকেছে। গত দুই দিনে আরো কয়েক হাজার লোক অনুপ্রবেশের জন্য বাংলাদেশের ওপারে অপেক্ষা করছে বলেও জানান সচিব। বাংলাদেশ এরই মধ্যে মিয়ানমারের প্রায় চার লাখ নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি নতুন করে অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনায় বসতে বাংলাদেশ বারবার অনুরোধ জানালেও মিয়ানমার সাড়া দিচ্ছে না। ২০০৫ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
২০১৪ সালের এক বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত প্রায় ৩২ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে যে দুই হাজার ৪১৫ জনকে দিয়ে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল, তাদের নাগরিকত্ব যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। মিয়ানমার স্বীকার করেছে, ওই দুই হাজার ৪১৫ জন তার দেশের নাগরিক।
জানা গেছে, মিয়ানমারের অতীতের সরকারগুলোর মতো বর্তমান সরকারও রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিকীকরণ নীতি অনুসরণ করছে। ছিনিয়ে নেওয়া নাগরিকত্ব ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। বেআইনিভাবে রোহিঙ্গাদের সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে। নির্মমভাবে তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর রোহিঙ্গা সমস্যাই এখন দুই দেশের সম্পর্কের অগ্রগতিতে বড় বাধা। বাংলাদেশ চেয়েছে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক বিভিন্ন খাত যেমন সড়ক যোগাযোগ, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল, বাণিজ্য জোরদার করতে। এ ক্ষেত্রেও মিয়ানমার গড়িমসি করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপে পড়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে নতুন সীমান্ত চেকপোস্ট স্থাপন, সীমান্ত বাণিজ্য বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো ১৯৮০ সালের সীমান্ত ব্যবস্থা চুক্তির লঙ্ঘন বলে জানা গেছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, শরণার্থী শিবিরের বাইরে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে অবস্থান করছে। তাদেরও ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজি নয়। আবার ওই পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়েও উদ্যোগ নিতে পারেনি বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি গত মাসে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পরিদর্শনের পর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে এ সংকট সমাধান না হলে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ঝুঁকির কথা বলেছিলেন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রাখাইন কমিশনও তার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মিয়ানমার সরকারকে সতর্ক করে বলেছে, রাখাইন রাজ্যে উগ্রবাদের উত্থান ঠেকাতে এবং শান্তি ফেরাতে চাইলে মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও তাদের চলাফেরার ওপর আরোপিত বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করতে হবে। উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো অধিকারবঞ্চিত রোহিঙ্গাদের তাদের দলে ভেড়াবে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যেভাবে বল প্রয়োগ করে মৌলিক অধিকার বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের দমন করতে চাচ্ছে, তা সফল হবে না বলেও কমিশন সতর্ক করেছে। জাতিসংঘ ওই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর সমন্বিত হামলার জন্য রোহিঙ্গাদের জঙ্গিগোষ্ঠীকেই দায়ী করা হচ্ছে। গত অক্টোবর মাসে হামলার জন্যও একটি রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়েছিল। এসব হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার চাপে থাকা বাংলাদেশ নতুন করে রোহিঙ্গা নিয়ে আর চাপ বাড়াতে চায় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যখনই অস্থিরতা, সংঘাত-সহিংসতা দেখা দিয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়েছে তখনই রোহিঙ্গাদের অন্যত্র চলে যাওয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার প্রবণতা বেড়েছে। তাই শরণার্থী শিবিরের বাইরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা চার-পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে আশঙ্কা করা হয়। গত বছরের অক্টোবর মাসে মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকেই ৮৭ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূখণ্ডে ফেরত পাঠিয়ে এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে আগ্রহী। কিন্তু মিয়ানমারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া মিলছে না। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের ‘জাতিগত নিধন’ নীতিও গোপন কিছু নয়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার তার নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করছে না। তাই তাদের ফিরিয়ে নিতেও মিয়ানমার মোটেই আগ্রহী নয়।
মজার মজার ভিডিও দেখতে নিচে লিংকের ক্লিপ করুণ https://www.youtube.com/channel/UCDUgcFp1WTEUfSzViR9tozA

Comments