রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ নিয়ে বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের মানুষের মাঝেও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। নানা রকমের সহিংসতা চলছে । রাখাইন রাজ্যে আন্দোলন , ভয়াবহ দাঙ্গা আর নির্যাতনের হাজারো ঘটনা উঠে আসছে আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমেও। মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হাজারো রক্তাক্ত, বীভৎস ছবি নিজের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার দিয়ে অথবা আপলোড করে প্রতিরোধের ঘোষণা দিচ্ছেন সবাই ।
সেখানে নির্যাতন রক্তপাত হচ্ছে সত্যি। কিন্তু সেই রক্তপাত আর নির্যাতনের আসল দৃশ্যের বদলে একদল উদ্দেশ্যপ্রনদিত ভাবে প্রচার করছে অনেক পুরোনো এমনকি ফটোশপে এডিট করা ভয়াবহ কিছু ছবি।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বেশিরভাগ জানেনা সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবহার। আবার ফেসবুককেই অনেকে ভাবেন ‘ইন্টারনেটের সবকিছু’ ! এসব ছবির প্রচারে অনেকেই হয়তো সুচারুভাবে, নয়তো না বুঝেই শেয়ার করছেন । আর এভাবেই সাধারন মানুষের ধারনায় আসছে ঘটনার ভিন্ন প্রবাহ । আমাদের উদ্দেশ্য সত্য জানানো ।
সচেতন মহলের ধারনা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতেই চলছে এই অপচেষ্টা। আবার অনেকেই বলছেন, এমন মিথ্যে ছবি ‘প্রশ্নবিদ্ধ করছে ‘ পুরো বিষয়টিকেই। কোন জাতি- ধর্ম নয় ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এমন দাবীতে আমরা সবাই সোচ্চার হবো যে-কোন অন্ন্যায়ের বিরুদ্ধেই । তবে সেই প্রতিবাদের ভাষায় যদি লুকিয়ে থাকে ‘মিথ্যা’ কিছু! তাহলে সে প্রতিবাদ কতটুকু গ্রহনযোগ্য তা সহজেই অনুমেয় ।
আমরা জানি, জাত-পাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বিচার করে মানবাধিকার হয় না। পৃথিবীর সকল মানুষের ধমণিতে একই রক্ত প্রবাহমান। বার্মার রাখাইন কিংবা রোহিঙ্গা, বাংলার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান কিংবা আদিবাসী সবারই মৌলিক অধিকার একই। একজন নিপীড়িত হিন্দু আর নিপীড়িত মুসলিমের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই , অথচ আমরা অনেকেই ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে এখনো কেবল বিভেদ রচনা করে চলেছি।কিছু মানুষ উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে সুনির্দিষ্ট আলামত ছাড়া ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে ফেসবুকে ছবিগুলির মিথ্যা কাহিনী রটিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক পোস্ট দিচ্ছেন । এতে একদিকে সম্প্রীতি বন্ধন যেমন জখম হচ্ছে অপরদিকে জাতিগত ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে ।
নিচে বহুল প্রচারিত কিছু ছবি এবং লিংক দেয়া হলো, এগুলো মিয়ানমারে নির্যাতনের ছবি নয়!
ছবির সত্যতা নিশ্চিত করতেই লিংক সহ দেয়া আছে। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ভাষায় থাকুক শতভাগ সত্যতা। সময়ের কণ্ঠস্বরের পাঠকদের জন্য কিছু ছবি তুলে ধরা হলো এখানে ।
প্রথম ছবিতে যা দেখছেন তা ২০১০ সালে প্রথম সাড়া ফেলেছিলো । তখন বলা হয়েছিল আফ্রিকায় খৃষ্টানদের দ্বারা মুসলিম পুড়িয়ে হত্যার ছবি। ২০১১ সালে ইংরেজি ব্লগসাইটে দেখা মিলে অন্যরুপে! ছবির ক্যাপশনে ছিলো, নাইজেরিয়ান মুসলিম দ্বারা খৃষ্টান হত্যা। যাহোক এই ছবিগুলো আবার দেখলাম ২০১৩-১৪ তে ! ঐ মুসলিম হত্যার বর্ণনা। ২০১৫ সালে এ ছবি আবার প্রকাশিত হয়। এবারের ক্যাপশন হলো এবার- “বোকো হারাম কর্তৃক নাইজেরিয়ান খৃষ্টানদের হত্যা”। এখন নতুন করে দেখা মিলেছে একই ছবির! কেউ কেউ মুসলিম হত্যা আবার কেউ কেউ রোহিঙ্গা হত্যা বলে অনলাইন সয়লাব করে দিচ্ছে।
মূল কাহিনী- ২০১০ সালে কঙ্গোর সাঙ্গে গ্রামে তেলের ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে ২৩০ জন পুড়ে ও দমবন্ধ হয়ে মারা যায়।
সুত্র-http://reut.rs/1Fw721z
দ্বিতীয় ছবি: এই ছবিটিও ঘুড়ে ফিরে আবার এসে গেছে বাজারে। বলা হচ্ছে এইটাও রোহিঙ্গাদের অবস্থা।
মুল ঘটনা- ছবিটি ২০০৪ সালের। থাই আর্মিরা বেশ কিছু থাই মুসলিমকে গ্রেফতার করলে তাদের আত্মীয়স্বজনরা বিক্ষোভ করলে ওদেরও গ্রেফতার করে (প্রায় ৮০ জন) ক্যাভার্ড ভ্যানে গাদাগাদি করে আটকিয়ে রাখায় দমবন্ধ হয়ে এরা মারা যান। প্রমাণ- http://bit.ly/1cbYXke
তৃতীয় ছবি: আরেকটা বহুল ব্যবহার্য ছবি। এই ছবির আবির্ভাব ঘটেছে বেশ কয়েকবার । প্রপাগান্ডায় এর শিরোনাম থাকে যে, রোহিঙ্গাদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। মূল কাহিনী হলো- দালাইলামা ইস্যুতে চীন আর তিব্বতের দীর্ঘদিনের জটিলতার মাঝে চীনের প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের ভারত সফরের আগেরদিন (২০১২ সাল) দিল্লীনিবাসী জামপেল ঝেসি নামে তিব্বতীয়ান ২৭ বছরের নাগরিক নিজের গায়ে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রমাণ- http://bit.ly/1FxrA9a
চতুর্থ ছবি: এটা সবচেয়ে বেশী ফেসবুকে আনা হয়েছে। স্টপ কিলিং মুসলিম নামক প্রপাগান্ডা মেশিন থেকে দুইদিন পর পর এটা আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হয়। লাল গেরুয়া পড়া বৌদ্ধভিক্ষুদের সাথে অনেক লাশ দেখিয়ে বলা হচ্ছে ভিক্ষুরা নির্বিচারে মুসলিম হত্যা করেছে।
২০১০ সালে তিব্বতের জুসু নামক স্থানে ৬.৯ মাত্রার ভুমিকম্পের ফলে সরকারিভাবে ২৭০০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়, নিখোজ অনেক। এ ভুমিকম্প জুসু ভুমিকম্প হিসেবেই পরিচিত। স্থানীয় বৌদ্ধমন্দির থ্রাংগু মনেস্টারীর অনেক ভিক্ষু ও এর আশেপাশের গ্রামে বহু হতাহত হয়। বেঁচে থাকা ভিক্ষুরা কোনো উদ্ধারকর্মীদের আসার আগেই নিজেরা আহত/নিহতদের উদ্ধার করে। দ্রুত নিহতদের সৎকার করার ব্যাবস্থা নেন । প্রমাণ- http://bit.ly/1AMpEht , http://bit.ly/1vgWj6u
পঞ্চম ছবি: এ ছবিটা রোহিঙ্গাদের সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। মূলত ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে ১৭৪জন রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে পারি জমালে থাই জলসীমা থেকে তাদের বিতারিত করে থাই পুলিশ। অসহায় অবস্থায় সমুদ্রে ভাসমান থাকলে ইন্দোনেশিয়ার লোকজন এদের উদ্ধার করে। মুল ছবি সুত্র– http://bit.ly/1czJ6Ch
ষষ্ঠ ছবি: একটা ঘরে কিছু মৃত শিশুকে রাখা হয়েছে। একটা শিশুর বুকের কাছে জামা ধরে একহাতে নিয়ে যাচ্ছে, ইত্যাদি।
বাচ্চাদের বীভৎস লাশ ও ক্ষত নিয়ে নিয়ে আরোও কিছু ছবি । যে কারোই রক্ত জ্বলে উঠবার কথা এমন ছবি দেখলে। সেই আবেগকে কাজে লাগিয়ে বারবার প্রচারিত হয় এমন দৃশ্য । মুল ছবি সুত্র- – http://bit.ly/1FxE7cI
অষ্টম ছবি: দেখেন তো ছবিটাতে ভিক্ষুটির বয়স কত? বন্দুকটি কি আসল মনে হচ্ছে? একটা শিশুর খেলনা বন্দুক নিয়ে নিছক খেলাকে এরা হত্যাকারী হিসেবে প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে গেছে। প্রমাণ- http://bit.ly/1eRlNFN
এই ছবি নিয়ে প্রচারনা অনেক বেশি। কিভাবে রোহিঙ্গা শিশুদের নির্যাতন হচ্ছে তার সরব বর্ননায় নানা কল্পকাহিনী আসলেও বাস্তবের ঘটনা সম্পুর্ন আলাদা ।
এক মা তার স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, – bago ko nga plang alagang aso haha…lakas ng tama ng anak ko sunod sunuran namn..#dami kong tawa d2 grabe… ইংরেজিতে এর অর্থ -“Meet my new pet puppy hahaha…my son is crazy obeys whatever I told him to do…just give me a big laugh…”
সুত্র লিংক – http://bit.ly/1cAgUiC
সপ্তম ছবি: ২০১০ সালের হাইতির ভুমিকম্পের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। আলোচ্য ছবিটা হাইতির ভুমিকম্পের পর মর্গের ছবি। ছবি সুত্র – http://ind.pn/1czNtNR
একাদশ ছবি: তুরষ্কে বৌদ্ধদের উপর সরকারীভাবে আক্রমন করা হচ্ছে এমন প্রচারে সরব সামাজিক মাধ্যম । সত্য ঘটনা আসলে আসলে সেই চীন-তিব্বত সমস্যার । প্রমাণ- http://bit.ly/1IgWOpa, http://bit.ly/1KdXSMW
দ্বাদশ ছবি: গলায় ফাঁস দেয়া এই ছবিটা খুব হিট ফেসবুক টুইটারে। প্রকৃতপক্ষে এলটিটিই এর বিরুদ্ধে শ্রীলংকান সেনাবাহিনীর অভিযানে হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল সেগুলির ছবি- http://bit.ly/1JqeaCZ
ত্রয়োদশ ছবি: এটার প্রকৃত কাহিনী হলো ২০১২ সালের। তিব্বতী ভিক্ষুদের চীনা পুলিশ এরেস্ট করে। প্রমাণ- http://bit.ly/1H6RqX5
চতুর্দশ ছবি: ছবিটি ব্লার করে দিলাম। ছবিটা রোহিঙ্গাদের হত্যার নয়, আইএসআইএস (ISIS) দ্বারা খৃষ্টান নাগরিক হত্যা। প্রমাণ- http://bit.ly/1ROtKKf
পঞ্চদশ ছবি: স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে আইনশৃংখলা বাহিনী একজন নিগ্রো। এটা কেমন করে বার্মিজ হয় ? ঘটনা ২০০৮ এর। ছবিটতে পুলিশ জিম্বাবুয়ের এক শরনার্থীর গায়ের আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। দক্ষিন আফ্রিকার স্থায়ী জনগন জিম্বাবুয়ে থেকে আগত উদ্বাস্তুদের আক্রমণ করে, মানুষের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে সরকারী হিসেবে ২৩ জন মানুষ মারা যায়। প্রমাণ- http://bit.ly/1BNMVul এর ২য় ছবি।
ষষ্ঠদশ ছবি:আলোচ্য ঘটনাটা হলো স্ত্রী প্রতারণা করায় ম্যাচেটি দিয়ে স্বামীর আক্রমন থেকে ভয়াবহ ক্ষত শরীরে স্ত্রী । প্রমাণ- http://bit.ly/1KejoRq
সপ্তদশ ছবি: তামিল টাইগারদের উৎখাতে শ্রীলঙ্কান সামরিক অভিযানে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়, সেগুলির একটা ছবি এটা। প্রমাণ- http://bit.ly/1IhfKEd
অষ্টদশ ছবি: তামিল টাইগারদের উৎখাতে শ্রীলঙ্কান সামরিক অভিযানে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়, সেগুলির একটা ছবি এটা। প্রমাণ- http://bit.ly/1cBzt6f
উনবিংশ ছবি: দুটি ছবির সাথে বস্তুত কোন সম্পর্কই নাই মুসলিম বা রোহিঙ্গাদের। এটা কম্বোডিয়ার একটা দুর্ঘটনার ছবি। ১৮ চাকার লরীর সাথে দুর্ঘটনায় বাচ্চা মেয়েটার মাথা পৃথক হয়ে গেছে। বাবা মেয়ের মাথা ধরে আছে, আর মা মেয়ের শরীর ধরে নির্বাক হয়ে গেছে। প্রমাণ- http://bit.ly/1QbrUWf, http://cnn.it/1KIG3DC
বিংশ ছবি: ব্যাংককের পথে বেআইনি বাইক চালানোয় ৪২৫ জনকে বাইকসহ আটক করে এভাবেই শুইয়ে রাখা হয়। অথচ এই ছবিই হয়ে ওঠে রোহিঙ্গা অত্যাচারের গল্প grin emoticon প্রমাণ- http://bit.ly/1IhmYbk
একবিংশ ছবি:জঙ্গী বোকো হারাম কর্তৃক খৃষ্টান নাইজেরিয়ানদের হত্যার ছবি এটা। অপপ্রচারে কল্যাণে মুসলিম নিধন হয়ে গেছে বর্তমানে। প্রমাণ- http://bit.ly/1FB1iTv
ধন্যবাদ সবাইকে। পরের পর্বে মিয়ানমারের মুসলমানদের উপর বর্বর হামলা ও নির্যাতনের সত্যিকারের দৃশ্যগুলো নিয়ে থাকছে একটি ফিচার ।
Comments
Post a Comment
Thanks for you comment