১২ দিনে এসেছে১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাদের ঢল, সরকারে উদ্বেগ

পেছনে সহিংসতার তাড়া, সামনে অনিশ্চয়তা—এ দুই নিয়ে উদ্বেগে ভরা নারী–শিশু–যুবার তিনটি মুখ। সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন তাঁরা। কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং শিবিরের কাছে একটি খোলা ট্রাক থেকে গত রোববার তোলা ছবি l এএফপিগতকাল সোমবার দিনের শুরুতে টেকনাফ-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক, এরপর টেকনাফের খানজরপাড়ার কাছে অসংখ্য রোহিঙ্গা চোখে পড়ল। খানিকটা এগোতেই দেখা গেল বিজিবির সদস্যরা রাস্তার দুধারে জড়ো হওয়া লোকজনকে গাড়িতে তুলছেন। গাড়ির বহর অনুসরণ করে থামলাম হোয়াইক্যং উঞ্চিপ্রাং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে। এরপর পায়ে হাঁটা শুরু। প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের কাঁচা-পাকা পথ পেরিয়ে থামলাম পুটিবুনিয়ায়। এখানকার টিলা আর আবাদি জমি মিলিয়ে হোয়াইক্যংয়ের প্রায় ৫০ একর জায়গায় তিন দিন ধরে ঠাঁই নিয়েছে প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা।
গত ২৫ আগস্ট সকালে কাজে গিয়ে বাড়ি ফেরেননি মাংগালা গ্রামের তরুণ আরিফুল্লাহ। এরপর থেকে অনেক ছোটাছুটি করেও আরিফুল্লাহর খোঁজ পাননি তাঁর স্ত্রী হুমায়রা বেগম। এদিকে গ্রামের বাড়িঘর পোড়ানোর তাণ্ডবে ব্যস্ত মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। এ পরিস্থিতিতে মা আর বোনদের নিয়ে ৩১ আগস্ট রাতে পাঁচ মাসের মেয়ে জেসমিনকে বুকে আগলে টেকনাফে চলে এসেছেন হুমায়রা। স্বামী সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁর স্বামীকে গুলি করে হত্যার পর পুড়িয়ে মারার খবর জেনেছেন।
জাতিসংঘের স্থানীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, গত বছরের অক্টোবর এবং এ বছরের ২৪ আগস্টের সেনা অভিযানের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেছে। গত অক্টোবরের পর বাংলাদেশে আসে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। এবার সংখ্যাটি আগেরবারের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
গতকাল স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত চার দিনে টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ৩৩টির বেশি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। এর আগের আট দিনে এসেছে আরও ৬০ হাজার। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা ঢুকেছে বলে তিনি জেনেছেন।
এদিকে হুড়োহুড়ি করে নাফ নদী পারাপার করতে গিয়ে গত চার দিনে রোহিঙ্গাবোঝাই ছয়টি নৌকা ডুবে গেছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত ৫৭ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত থাকায় সরকার ‘কিছুটা চিন্তিত ও ক্ষুব্ধ’। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ, মানবিক সহায়তার অবস্থা এবং মিয়ানমারের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে ওই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। মালদ্বীপ বলছে, তারা মিয়ানমারের সঙ্গে সব রকম অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজ মঙ্গলবার মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে আসছেন। আজ বিকেল চারটায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এবং সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর দেখা করার কথা রয়েছে। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে মারসুদি বাংলাদেশ সফর করেন।

প্রাণ বাঁচাতেই তারা পালিয়ে এসেছে
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছে, রক্ত আর পোড়ানোর নেশায় মরিয়া মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একদল উন্মত্ত তরুণ। তারা সেনা-পুলিশের উপস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের খুন করছে।
মংগদুর তুলাতলি এলাকার ২৮ বছরের তরুণ ফরিদুল্লাহ ৩০ আগস্ট হারান মা, স্ত্রীসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে। মিয়ানমারের সেনারা ওই দিন তাঁর মা আছিয়া বেগম, স্ত্রী আরখাতু বেগম ও তিন মেয়ে কিসমত, আসমত ও শামীমাকে কুপিয়ে হত্যা করে। ফরিদুল্লাহ জানালেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তাঁদের এলাকায় পুরুষদের গুলি করে আর নারী ও শিশুদের কুপিয়ে খুন করছে।
পুটিবুনিয়ায় দেখা হওয়া হুমায়রা আর আরিফুল্লাহরা স্বজন হারালেও অস্থায়ী বসতিতে আশ্রয় নেওয়া বেশির ভাগ রোহিঙ্গাই জানাল, তারা বাংলাদেশে এসেছে তিন দিন আগে। নিজেদের স্বজনদের হারানোর ভয়ে আগুনের লেলিহান শিখায় উন্মত্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে তারা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। এখন আপনজন নিয়ে যেখানেই পারছে, সেখানেই ঠাঁই খুঁজছে। যদিও পুটিবুনিয়ার টিলা আর আবাদি জমির মাঝখানে খাবার, পানীয়সহ মানবিক প্রয়োজনের অনেক কিছুই এখন নেই।
হোয়াইক্যংয়ের পুটিবুনিয়ার প্রায় ৫০ একর জায়গায় গত শনিবার রাত থেকে রোহিঙ্গাদের জড়ো করছে বিজিবি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তা ও সামাজিক নানা সমস্যার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যাতে হুমকি তৈরি না করে সেটি বিবেচনায় নিয়ে তাদের এক জায়গায় জড়ো করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুটিবুনিয়ায় জড়ো হওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারসহ প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গজরবিলের দিনমজুর রশিদ আহমদ (৬৫) বলেন, ‘প্রাণ বাঁচাতে পরিবারের ২১ জন নিয়ে পালিয়ে এসেছি। সঙ্গে পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু আনতে পারিনি। আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়িতে শতাধিক গরু ও ছাগল ছিল, সেগুলো নিয়ে গেছে সেনারা।’
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে দুপুর ১২টার দিকে মেরিন ড্রাইভের জাহাজপোড়া এলাকায় বেশ কটি স্কুটারের জটলা দেখে থামলাম। নারী, পুরুষ, শিশুসহ ৩৫ জনের একটি দল এখন আশ্রয়ের খোঁজে টেকনাফ-যাত্রা করছে। এদেরই একজন মংগদুর গর্জনদিয়া গ্রামের বর্গাচাষি আবদুল আলীম। তিনি জানালেন, রোববার দিবাগত রাত দুইটার দিকে নৌকায় চড়ে এখানে নামেন। সকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে তাঁদের টেকনাফের অস্থায়ী বসতির দিকে চলে যেতে বলেছেন। রাখাইন ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে আলীম জানান, শুক্র, শনি ও রবি টানা তিন দিন তাঁদের গ্রামে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রোববার এক দিনেই জবাই করা হয়েছে ১১ জনকে। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে পালিয়েছেন।
এর আগে গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, টেকনাফের হোয়াইক্যং খানজরপাড়া ধানখেত দিয়ে রোহিঙ্গাদের ২০ জনের একটি দলকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেখা যায়। এ সময় মংগদুর বলিবাজারের নুর বেগম নামের একজন জানান, ‘বেড়িবাঁধের পাশে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু জোয়ারের সময় নাফ নদীতে পানি বেশি থাকায় অপেক্ষা করছে তারা। আমরা সাঁতরে এসেছি। টাকাপয়সা না থাকায় কোথাও যেতে পারছি না। বিজিবিও বাংলাদেশে ঢুকতে দিচ্ছে না।’ আরেকটু সামনে খানজরপাড়া মসজিদসংলগ্ন পুকুরপাড়ে দেখা মিলল দেড় শতাধিক শিশু-নারী ও পুরুষ রাস্তার পাশে এলোমেলোভাবে বসে আছে।
স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) রোববার জানিয়েছে, রাথিডংয়ের অন্তত ৭০০ বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এইচআরডব্লিউর এশিয়াবিষয়ক উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, নতুন স্যাটেলাইট চিত্রে যা দেখা গেছে তা পরিস্থিতি সম্পর্কে যা ধারণা করা হয়েছিল, তার চেয়ে ভয়াবহ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢলের মধ্যেই বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের অংশে দুটি বিস্ফোরণ ঘটেছে।মিয়ানমারের একটি গ্রামের কাছে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাওয়াসহ কালো ধোঁয়া উড়তে দেখার কথা জানিয়েছেন রয়টার্সের সংবাদদাতারা।
দিনের শেষে সূর্যটা ডুবু ডুবু করছে। সরেজমিনে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখে টেকনাফ সদরে ফিরছিলাম। বাঁ পাশে নাফ নদী ধরে এগোনোর সময় চোখে পড়ল শেষ বিকেলে আগুনের লেলিহান শিখা। এ পাড় থেকে দাঁড়িয়ে অন্তত ছয় জায়গায় দাউ দাউ আগুন দেখা গেল।
মজার মজার ভিডিও দেখতে নিচে লিংকের ক্লিপ করুণ https://www.youtube.com/channel/UCDUgcFp1WTEUfSzViR9tozA

Comments