একজন বিপুল চাকমার মাতৃশোক

মায়ের কফিনের পাশে বিপুল চাকমা। ছবি: নীরব চৌধুরীশোকের রং কালো আমাদের। কারও শোক কি বেশি কালো? অশ্রুর স্বাদ নোনতা আমাদের। কারও কারও অশ্রুর নোনার সঙ্গে কি দুর্বহ জ্বালাও মিশে থাকে? বিপুল চাকমা জানেন। শোকের এই জ্বালা শুধু বিপুল চাকমাই জানেন। কোলন ক্যানসারে মা মরণাপন্ন। সেই মাকে নিয়ে খাগড়াছড়ি থেকে একটা মাইক্রোবাসে করে তিনি ছুটছিলেন চট্টগ্রাম হাসপাতালের দিকে। পথের মধ্যে পানছড়ি থানা, পথের মধ্যে তল্লাশি। মায়ের সামনে ধস্তাধস্তি, মায়ের বাধা উপেক্ষা করে তাঁকে তোলা হয় পুলিশের গাড়িতে। বিপুল চাকমা ছাত্রনেতা। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। তাঁর নামে ১৫টি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে বলে জানিয়েছেন পানছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (প্রথম আলো ২৪ অক্টোবর, চট্টগ্রাম সংস্করণ)। বিপুল চাকমা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পক্ষে আন্দোলনরত ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে মামলা থাকা অস্বাভাবিক নয়।
পুলিশ কি এমন আসামিকে হাতে পেয়ে ছাড়তে পারে? বিপুল চাকমা তো খুনের মামলার আসামি সাংসদ আমানুর নন, যিনি সংসদ সদস্যপদ ধরে রাখতে সংসদে হাজিরা দেন ঠিকই; কিন্তু পুলিশ তাঁকে খুঁজে পায় না। বিপুল চাকমা তো গাজীপুরের টাম্পাকো কারখানার মালিক সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেন নন, শিল্প দুর্ঘটনায় ৪২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় পরোয়ানা থাকলেও পুলিশ যাঁকে খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ তিনি দিব্যি আড়ালে থেকে কলকাঠি নেড়ে কারখানার মালামাল সরাতে পারছেন! কারণ এঁরা কেউকেটা মানুষ। আর বিপুল চাকমা কেউ-না।
বিপুল চাকমা কেউ-না। যিনি কেউ-না, তাঁর মরণাপন্ন মা-ও কেউ-না। সেই সামান্য পুত্রের মা নিরুদেবী চাকমা (৪৫) যদি সন্তানের গ্রেপ্তারের ঘটনায় মনে আঘাত পেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন, তবে এর দায়ও নিশ্চয়ই কারোরই না। বিপুল চাকমাকে পুলিশ নিয়ে গেলে নিরুপমা দেবী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের বড় হাসপাতালের বদলে তাঁকে ভর্তি করা হয় কাছেরই খাগড়াছড়ি হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
সন্তানের মুখ শেষবারের মতো দেখলেন না হতভাগ্য মা। মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখতে পারলেন না বিপুল চাকমাও। কিন্তু কর্তৃপক্ষের দয়া হলো। মায়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে থাকার আবেদনের ভিত্তিতে তাঁকে সাত ঘণ্টার জন্য প্যারোলে জেলের বাইরে আসতে দেওয়া হয়। এই অনুকম্পাটি আরও আগে করা যেত না? জানি না, আইন এখানে কী বলবে। ঠিক ওই সময়ই ওইভাবে ছেলে গ্রেপ্তার না হলে হয়তো মা আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন।
ধরা যাক, একজন চিকিৎসক অপরাধ করে ফেলেছেন। তাঁকে আটক করতে এসে পুলিশ দেখল, তিনি জরুরি অসুস্থ একজন রোগীর দেহে অস্ত্রোপচার করছেন। ওই মুহূর্তে তাঁকে গ্রেপ্তার করলে চিকিৎসার অভাবে রোগী মারা যাবেন। এমন মুহূর্তে পুলিশ কী করবে? আসামি বিপজ্জনক ভেবে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসাসেবা দানরত হাতে হাতকড়া পরাবে? নাকি তাঁকে পাহারা দিয়ে রেখে অপেক্ষা করবে?
এমন পরিস্থিতির কথা আইনের বইয়ে লেখা থাকে না। মানুষের জীবনে এমন পরিস্থিতি আসে, যখন মানবিকতা, দূরদর্শিতা ও মায়ামমতা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মানুষ প্রোগ্রাম করা রোবট নয়। মানুষকে উচিত কাজটা শেষ পর্যন্ত নিজের বিবেকের সঙ্গে মিলিয়েই করতে হয়। সেই বিবেক ও মনুষ্যত্বের কাছে প্রশ্ন: বিপুল চাকমাকে কি প্রহরায় রেখে আরও পরে গ্রেপ্তার করা যেত না? তাঁকে কি মায়ের চিকিৎসার স্বার্থে, মরণাপন্ন মায়ের পাশে থাকার জন্মগত অধিকারের স্বার্থে নজরদারিতে রেখে জামিন আবেদন করার সুযোগ দেওয়া যেত না?
বিপুল ছাত্ররাজনীতি করেন, তাঁকে জেলে যেতে হতেই পারে। কিন্তু মরণাপন্ন মায়ের পাশ থেকে ছেলেকে জোরজবরদস্তি করে গ্রেপ্তার করা কি মরণাপন্ন মায়ের চিকিৎসায় বাধা দেওয়া নয়? সেটা কি জীবনের অধিকারের বিপক্ষের কাজ নয়?
প্যারোলের ওই সাত ঘণ্টা বিপুল চাকমার হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। হাতকড়ার সঙ্গে বাঁধা দড়ি ধরা ছিল পুলিশের হাতে। বিপুল মায়ের শেষকৃত্য করেন পুলিশ ও বিজিবির পাহারায়। সেই শোকসভায় দাঁড়িয়েই শোকার্ত আত্মীয়-প্রতিবেশীর সামনে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমার মা মরে গেলেও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার হাজার হাজার মা আছে।’ (সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৬ অক্টোবর)
বিপুল চাকমা অপরাধ করে থাকলে আদালতের মাধ্যমে তাঁর নিরপেক্ষ বিচার হোক। কিন্তু পুলিশ কি এ ঘটনার মধ্যকার অমানবিকতাটি দেখতে পাবে? আইন বাস্তবায়ন করা মানে মানবতার জন্যই কাজ করা। তা করতে গিয়ে অমানবিক কি হতেই হয়? আইন বাস্তবায়নের নামে যদি আরও গভীরতর অন্যায় ঘটে যায়; তার কি কোনো বিচার নেই?
জীবন কি বিপুল চাকমাদেরও নয়?
Source অনলাইনে টাকা ইনকাম করতে চাইলে নিচে লিং এর সাইট থেকে রেজিস্ট্রেশ করে ইনকাম করুন https://www.bestchange.com/?p=367744 মজার মজার ভিডিও দেখতে নিচে লিংকের ক্লিপ করুণ https://www.youtube.com/channel/UCDUgcFp1WTEUfSzViR9tozA

Comments