ভুবনজয়ী তারুণ্য প্রকৃতি ও মানুষই প্রেরণা

নানামুখী প্রতিভা নিয়ে তরুণেরা ছড়িয়ে পড়ছেন চারদিকে। তেমনই এক কৃতী তরুণ বন্য প্রাণী সুরক্ষায় ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশের আনাচকানাচে
শাহরিয়ার সিজার রাহমানবাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর। কখনো শহুরে পরিবেশ, কখনোবা মফস্বলের মায়ায় দিন কাটিয়েছি। ঘন ঘন স্কুল বদলানোর কারণে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছি।
ছোটবেলায় শিশুরা যখন ভিডিও গেমস, খেলনা নিয়ে পড়ে থাকত, আমি তখন ছুটতাম হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল এসব প্রাণীর পেছন পেছন। তখন থেকেই প্রকৃতির প্রতি অন্য রকম এক টান বোধ করতাম। কখনো প্রজাপতির রঙিন ডানার পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে হারিয়ে যেতাম সবুজের মাঝে, কখনো মুরগির বাচ্চাগুলোকে আদর করতে করতে কাটিয়ে দিতাম এক প্রহর।
বড় হতে হতে একটা সময় দেখলাম, আমি নিজেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি। বুঝতে পারছি না বড় হয়ে কী হওয়া উচিত। আশপাশের পরিবেশ, আমার পরিবার—সবার সঙ্গেই একটা অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি হতে থাকল। আমি গুটিয়ে যেতে থাকলাম নিজের ভেতর। স্কুলজীবনের শেষ পর্যায়ে আমার জীবনের মোড় ঘুরল। পড়াশোনা করতে আমি চলে গেলাম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। সেখানে শুরু হলো আমার নতুন পথচলা।
যুক্তরাষ্ট্রে হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকে আমি বিভিন্ন প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করি। প্রথম কাজ করি বিভিন্ন ‘অ্যানিমেল শেল্টারে’। ব্যক্তিগতভাবে কুকুর আমার ভীষণ পছন্দ। দেশে যখন কুকুর নিয়ে মাতামাতি করতাম, সবাই হাসাহাসি করত। যুক্তরাষ্ট্রে শহরের ভেতর কুকুর, প্যাঁচা, ইঁদুর, শিয়াল—এদের সুস্থতা নিয়ে কাজ করতাম। এখানে কেউ বাধা দিচ্ছে না, বরং উৎসাহ পাচ্ছি।
স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে থাকলাম পাগলের মতো। একসময় প্রকৃতি সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াইল্ড মেট্রো’ থেকে সাড়া পেলাম। আমার মনে আছে, একবার তিমি গবেষণা দলের সঙ্গে আটলান্টিক মহাসাগরে জাহাজে বেশ কয়েক দিন ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রথম যেদিন একটা বড় তিমি আমাদের জাহাজের কাছে চলে এল, সেই মুহূর্তের আনন্দের সঙ্গে দুনিয়ার আর কোনো আনন্দের তুলনা হয় না। মনে হচ্ছিল, অবশেষে আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছি।
দেশের বাইরে গিয়ে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে, আয়-উপার্জন করে। আর আমি দিন-রাত ছুটে বেড়াতে থাকলাম স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। সবাই আমাকে বোকা ভাবত, আমি মুচকি হাসতাম। আমি তখন নিজের ভেতর শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছি। আমার মেন্টর, অধ্যাপক—সবাই খুব উৎসাহ দিতেন। সেখানে যত দিন ছিলাম, বিভিন্ন বন্য প্রাণী সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছি।
২০১১ সালে ফিরে এলাম। শুরু হলো নিজ দেশে স্বপ্ন বাস্তবায়নের যাত্রা।
দেশে ফিরে এসে শুরুটা কঠিন ছিল। কী করব, কীভাবে করব, এসব নিয়ে প্রচুর খাটতে হয়েছে। প্রথম অজগর সাপে ট্রান্সমিটার স্থাপন করে কাজ করার সময়গুলো একই সঙ্গে যেমন আনন্দের ছিল, সেই সঙ্গে ছিল অনেক চ্যালেঞ্জিং। তখন পরিবারও চায়নি, তাদের একমাত্র ছেলে বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এখানে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াক। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি সামলে নিয়েছি। তত দিনে আমি আত্মবিশ্বাসী।
বন্য প্রাণী ও পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট’ গঠন করি শুরুতেই। এরপর থেকে কাজের ক্ষেত্রগুলো কেমন করে যেন বেড়েই চলেছে। বন্য প্রাণী ও পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আমি লাউয়াছড়া থেকে একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামেও কাজ শুরু করি। সেখানে প্রত্যন্ত এলাকায় আদিবাসীদের সঙ্গে মানিয়ে চলা, তাদের বিশ্বাস জয় করা, বন্ধু হওয়া—সবকিছুই ঘটেছে আমার ভেতরের সেই আত্মবিশ্বাস আর স্বপ্নের পথে স্থিরতার কারণে। আমাকে একটানা ৪৫ দিনও থাকতে হয়েছে ওই সব প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় সদ্য পরিচিত হওয়া জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে।
কাজ করতে করতেই বেশ বুঝে গেলাম, এখানে বন্য প্রাণী আর পরিবেশ যদি রক্ষা করতে চাই, আমাকে এই আদিবাসী গোষ্ঠীকেও একইভাবে রক্ষা করতে হবে। এরা সবাই একই সুতোয় বাঁধা।
এর মাঝেই গঠন করি ‘ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স’ নামে পরিবেশ সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ সালের পয়লা মার্চ এই প্রতিষ্ঠানকে বৈধভাবে নিবন্ধন করা হয়। বর্তমানে আমার সব ধ্যানজ্ঞান বন্য প্রাণী ও পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি এই দুইয়ের ওপর পুরোদস্তুর নির্ভরশীল মানবগোষ্ঠীকে জড়িয়ে। এখনো ছুটে বেড়াচ্ছি ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম, কখনো লাউয়াছড়া, কখনো সুন্দরবন।
যখন দিনের পর দিন একা থাকতে হয় নেটওয়ার্কবিহীন ওই সব প্রত্যন্ত এলাকায়, তখন মাঝে মাঝে ভয়ংকর নিঃসঙ্গতা কাজ করে। এমনও হয়েছে, পাহাড়ি এলাকায় ঈদ করেছি। তা ছাড়া এখন কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যে বাধার মুখোমুখি হতে হয়, সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। ফান্ড প্রাপ্তির জন্য সারাক্ষণ মনের ভেতর দুশ্চিন্তা ঘুরতে থাকে। দুশ্চিন্তা হয়, মাস শেষে আমার সহকর্মী যাঁরা আছেন তাঁদের বেতন নিশ্চিত করতে পারব কি না। তবু দিন শেষে যখন ছোট ছোট সাফল্য আসে, পেছনের বাধাগুলো তখন আবছা চাদরে ঢাকা পড়ে যায়।
আমার এই কাজ নিয়ে আমি ঠিক কোথায় গিয়ে শেষ পর্যন্ত দাঁড়াব, তা নিয়ে খুব দৃঢ়ভাবে ভাবি না, শুধু জানি, আমার গন্তব্যটা পুরোপুরি স্বাধীন। প্রতিনিয়ত আমি যে পরিকল্পনাগুলো করছি, সেগুলো সফলভাবে করতে চাই, আর অবশ্যই কাজের পরিধিটা দিন দিন বাড়াতে চাই। নিজের দেশ, দেশের বাইরে—সবখানে আমার স্বপ্নের বীজ ছড়িয়ে দিতে চাই।
শাহরিয়ার সিজার রাহমান: বন্য প্রাণী সংরক্ষণকর্মী
mongsai79@gmail.com

Comments