ভবিষ্যতের বাংলাদেশ: রাজনীতি গণতন্ত্রে বহু সম্ভাবনা, নানা চ্যালেঞ্জ

আবু সুফিয়ানআবু সুফিয়ানরাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি—চারটি ক্ষেত্রে চার তরুণ লিখছেন ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সম্পর্কে। আজকের বিষয় রাজনীতি
বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। দীর্ঘদিনের পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা পেতে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হলো। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উদ্ধার করতে আন্দোলন হলো মুহুর্মুহু। এরপর মনে হলো, নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে গণতন্ত্র আবার স্বমহিমায় চলতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ২৬ বছর পার হলেও গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারল না। কারণ, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’-এর প্রাথমিক স্তরটিও অতিক্রম করতে সক্ষম হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ভোটের ও জোটের রাজনীতিতে ব্যস্ত। জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় ব্যানারে নির্বাচনী রাজনীতি গণতন্ত্রের আপাতসৌন্দর্য বৃদ্ধি করলেও ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের রাজনীতির জন্য শঙ্কাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আবার সাম্প্রতিককালে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যতটা সাড়া দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নকে গণতন্ত্রের সঙ্গে বিস্তৃতভাবে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ ততটা দেখা যাচ্ছে না।
ওপরের এত কথার পরে যে প্রশ্নগুলো সামনে এসে দাঁড়ায় তা হলো, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কি তাহলে কোনো অর্জনই নেই? এটা কি পুরোপুরি ব্যর্থ হলো? নির্বাচনী গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র এখানে আদৌ ভূমিকা রাখতে পারবে কি? তাহলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎটা কেমন হতে পারে?
এ কথা সত্য, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন পর্যন্ত সুসংহত হতে পারেনি। তাই বলে গণতন্ত্রের কোনো উপাদানই আমরা অর্জন করতে পারিনি, তা বলা উচিত হবে না। রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিবর্তন, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, জনমিতিতে শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের নিয়ত প্রসার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দাবি প্রভৃতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সঠিক পথে রাখার একটি অদৃশ্য চাপ সৃষ্টি করেছে বটে। সাম্প্রতিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, দল যোগ্য প্রার্থী দিলে তা ইতিবাচক ফল দেয়। তাই বিতর্কিত রাজনীতিকদের পাশ কাটিয়ে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির ব্যক্তিদের প্রার্থী করে নির্বাচনী গণতন্ত্রে সফল হওয়ার দিকে দলগুলোর মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে পারে।
এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াতেও অনেকে দোষ খুঁজবেন এবং খুঁজে পাবেনও। তবে দলগুলোর এই মানসিকতার পরিবর্তনও নির্বাচনী গণতন্ত্রের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে প্রসারের ইঙ্গিত দেয়। অনেকেই ভাবছেন, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে এই সর্বসাম্প্রতিক পরিবর্তন জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটা প্রাসঙ্গিক হবে। এ নিয়ে চিন্তাভাবনা ও বিতর্কের যথেষ্ট জায়গা আছে। রাজনৈতিক এসব পরিবর্তনকে পাশ কাটিয়ে এগোনোর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আগামী জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন, রাজনৈতিক সহিংসতা ও গায়ের জোরের সংস্কৃতির অসারতা, নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও পেশাদারি, গণমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান গ্রহণযোগ্যতা প্রভৃতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের রাজনীতিতে ক্রমশ নিয়ামক হয়ে উঠবে।
গণতন্ত্র বলতে বাংলাদেশে আমরা শুধু নির্বাচনী গণতন্ত্রই বুঝি; আর গণতন্ত্র খুঁজে বেড়াই কেবল সংসদ, সরকার, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল প্রভৃতির ভেতর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা সামাজিক গণতন্ত্রকে আলাপ-আলোচনা এবং বিচার-বিশ্লেষণে তাই খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের নাম শুনলে যাঁরা নাক সিটকান, সাম্প্রতিক কিছু সামাজিক আন্দোলনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে তাঁরা কিছুটা হলেও মৃদু আলো খুঁজে পাবেন। ২০১৫ সালে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপ করলে তাঁরা অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের দাবি শেষ পর্যন্ত আদায় করেছিলেন। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনু ধর্ষণ ও হত্যা-পরবর্তী সামাজিক আন্দোলনের দেশব্যাপী প্রসার ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্বের অভাবে এ ধরনের আন্দোলন খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না, তা ঠিক; তবে এসব আন্দোলনের রাজনৈতিক তাৎপর্য অসামান্য। এসব আন্দোলনে গোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেয়ে গোষ্ঠীগত স্বার্থ, ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ন্যায়বিচার, সমতা ও সুযোগের জন্য মুখর হয়ে ওঠে। এ ধরনের আন্দোলনকে গণতন্ত্রের প্রতিরূপ ছাড়া আর কোনোভাবে ব্যাখ্যা করার উপায় নেই। এসবের আরও বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এসব সামাজিক রূপান্তরের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিবর্তনের তাগিদ যেদিন একাত্ম হবে, সেদিনই বাংলাদেশ অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের মডেলে পরিণত হতে পারবে।
অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও উন্নয়নবিদের মতে, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রকে টেকসই গণতন্ত্রে রূপান্তর করতে হলে সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগের পাশাপাশি নাগরিকের অর্থনৈতিক সুযোগ ও সমতা থাকা দরকার। সমসাময়িককালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও ধনী-গরিব ও নগর-গ্রামের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের সবটুকু অর্জন ম্লান করে দেওয়ার শঙ্কা জাগছে। কারণ, বুর্জোয়া গণতন্ত্র এমন এক হাইব্রিড ব্যবস্থা, যা আপাতরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিতে পারলেও জনগণের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়। দীর্ঘমেয়াদি এই ব্যবস্থা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আবার উসকে দেয়। তাই গণতন্ত্রকে একটি বিন্দু ধরে যদি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগের সমান বণ্টন করা না যায়, তাহলে টেকসই গণতন্ত্র সম্ভবত বাংলাদেশের জন্য স্বপ্নই হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সম্ভাবনা যতটা, ততটা জুড়েই রয়েছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ। আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনগুলো গণতন্ত্রের বহুমাত্রিকতাকে যেভাবে উন্মোচন করছে, তার পরিচর্যা ও বিকাশ হলে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একদিন বৈশ্বিক মডেলে রূপান্তর করা সম্ভব। তবে এমন গণতন্ত্র আমরা চাই না, যার মডেল হবে শুধুই কাগজ-কলমে। আইনের শাসন, সুযোগের সমতা, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সম-অংশগ্রহণভিত্তিক গণতন্ত্রের পথেই গড়ে উঠুক ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।
আবু সুফিয়ান: সাবেক কৃতী শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ‘জননেতা আবদুর রাজ্জাক স্মৃতি স্বর্ণপদক’ ও ‘প্রফেসর ড. মোস্তফা চৌধুরী স্বর্ণপদক’-এর জন্য মনোনীত।
mongsai79@gmail.com

Comments