সহজিয়া কড়চা দিনটির চেয়ে জীবনাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ

দলীয় আনুগত্যের চেয়ে বাংলার মানুষের স্বাধিকার ও রাজনৈতিক মুক্তিই বড় ছিল আন্দোলনের সূচনাপর্বে
দলীয় আনুগত্যের চেয়ে বাংলার মানুষের স্বাধিকার ও রাজনৈতিক মুক্তিই বড় ছিল আন্দোলনের সূচনাপর্বেএকজন কী মাপের মানুষ তা বোঝা যায় সে তার প্রতিপক্ষ এমনকি শত্রুর সঙ্গেও কেমন আচরণ করে, তা থেকে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছলে–বলে–কৌশলে পরাজিত করা এক কথা আর তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা একেবারেই আর এক কথা। প্রতিপক্ষ বা শত্রু সম্পর্কে অসুন্দর বাক্য ব্যবহার খুবই নীচ কাজ। রাজনীতিকদের পেশার যে ধরন, তাতে প্রতিপক্ষকে কঠোর সমালোচনা করতেই হয়। সে সমালোচনা ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, জনস্বার্থে এবং জাতীয় স্বার্থেও।
৫০-৬০ বছর আগে আমাদের দেশের যাঁরা প্রধান রাজনীতিক ছিলেন, তাঁদের জীবন থেকে এ কালের রাজনীতিকরনেওয়ালাদের শেখার আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রের যাঁরা প্রতিষ্ঠাতা, তাঁদের রাজনীতি থেকে শুধু নয়, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনাচরণ থেকেও শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমবার খালেদা জিয়া যখন সরকার গঠন করেন, তখন তাঁর সরকারের একজন জুনিয়র মন্ত্রী ছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। তাঁদের মেয়াদের শেষের দিকে একদিন তাঁকে একান্তে পেয়ে বলেছিলাম, সরকার পরিচালনার কাজে আপনাদের কর্তব্য রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের কোনো কোনো বিষয় অনুসরণ করা। তাঁদের থেকে না শিখলে আপনারা সফল হতে পারবেন না। একই কথা বর্তমান সরকারের অনেক নেতাকে আমি বলেছি। তার সঙ্গে যোগ করেছি এইটুকু যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা আপনারা সারা দিন বলেন বটে, তবে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ থেকে আপনারা অনেক দূরে সরে এসেছেন।
এখন যেসব আওয়ামী লীগ নেতার বয়স ৫০-এর নিচে, তাঁদের বঙ্গবন্ধুর ছায়াটিও দেখার কথা নয়। তাঁরা শুধু টেলিভিশনের পর্দায় তাঁকে সাতই মার্চের জনসভায় ভাষণদানরত অবস্থায় দেখেছেন। মানুষটি কেমন ছিলেন, তা জানেন না বা জানার আগ্রহও নেই। তাঁকে তাঁর জীবনের প্রায় পুরো সময়ই প্রবল ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। সে তুলনায় এখনকার রাজনীতিকরনেওয়ালারা খুবই সুখী ও নিরাপদ।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল খুবই শক্ত মামলা। অতিনৈপুণ্যের সঙ্গে অভিযোগটি খাড়া করা হয়েছিল। পরিকল্পনামতো বিচার হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ সাজাই হতো। এক নম্বর আসামির সাজা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত। সেই মামলার বিচারের জন্য গঠিত হয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। সেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস এ রহমান। ওই ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করা যাবে না বলে বিধান করা হয়েছিল। পরে উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে ছাত্র-যুব-জনতা বিচারপতি রহমানের বাসভবন জ্বালিয়ে দেয়। ভবনটি ছিল বাংলা একাডেমির প্রবেশপথের পাশে, এখন যেখানে পুষ্টিবিজ্ঞান ভবন। আমাদের চোখের সামনে সুরম্য ভবনটি দাউ দাউ করে জ্বলে। যখন আগুন লাগানো হয়, তখন ভেতরে দোতলায় বিচারপতি রহমান ছিলেন। হতবিহ্বল বিচারপতি ঘরোয়া পোশাক পরা অবস্থায় খিড়কির দরজা দিয়ে পেছন দিকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। তা না করলে তাঁর মৃত্যু ছিল অবধারিত। বিক্ষুব্ধ জনতা বিচারপতির পালিয়ে যাওয়া উপভোগ করে।
ছাত্র-জনতার দাবির মুখে বিচার-প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যায় এবং শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্ত মুক্তি পান। ওই সময় আমাদের মতো তরুণদের ঘরবাড়ি বলে কিছু ছিল না। রাস্তায় রাস্তায়ই দিন-রাত কাটত। কার দলীয় আনুগত্য কী বা রাজনৈতিক মতাদর্শ কী, তা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। এক কথা—বাংলার মানুষের স্বাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তি।
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের নেতাদের সঙ্গে শুধু নয়, ছাত্র-যুবনেতাদের সঙ্গেও দীর্ঘ আলোচনা করেন। আন্দোলনের বিষয়বস্তু ছিল আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা। ছাত্রনেতাদের মধ্যে তিনি বিশেষভাবে বৈঠক করেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও আরও কারও কারও সঙ্গে। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দেন, ৬ দফা ও ১১ দফা নিয়ে যতক্ষণ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব আলোচনা করতে সম্মত না হন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর আহ্বানে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে রাওয়ালপিন্ডিতে যাওয়া সমীচীন হবে না। মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানীর সঙ্গেও গিয়ে দেখা করেন এবং রুদ্ধদ্বার কক্ষে একান্তে বৈঠক করেন। ভাসানী তাঁকে বলেছিলেন, ‘শোষকের সঙ্গে এক টেবিলে বসলে শোষিতের লাভ হয় না। ৬ দফা ও ১১ দফা নিয়ে যদি আইয়ুব আলোচনা করতে সম্মত না হন, তাহলে তাঁর ওই গোলটেবিলে তোমার না যাওয়াই উচিত।’ আমরা বাইরে থেকে যেটুকু জানতে পারি তা হলো, বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতাদের ও মাওলানাকে বলেছিলেন, ‘আমি সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। তার জন্য জনগণকে নিয়ে আন্দোলন করি। প্রেসিডেন্ট যখন আন্দোলনের মুখে আমাকে মুক্তি দিয়ে আলোচনা করতে চান, আমার ইসলামাবাদ যাওয়াই উচিত।’ সংসদীয় গণতন্ত্র তো সংলাপ ছাড়া সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর একক বিবেচনায় ইসলামাবাদ গিয়েছিলেন। যাহোক, সে কথা সবাই জানেন, তা আমার এখন আলোচনার প্রয়োজন নেই। তবে গোলটেবিল বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি।
মাওলানা ভাসানী এবং আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনে আমি সেকালের এই দুই দল ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলি। অনেকের সাক্ষাৎকার নিই। এককালের নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মাহমুদুল হক উসমানীর সাক্ষাৎকারও নিই। তাঁর করাচির বাসভবনের লনে বসে ঘণ্টা দুই তাঁর সঙ্গে কথা বলি।
পাকিস্তানকে যে মিলিটারিরা ভেতর থেকে ক্ষয় করে দিয়েছে, সে কথা বারবার তাঁর বক্তব্যে আসছিল। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি রাজনীতিকেরা চিন্তাচেতনায় ছিলেন অনেক অগ্রসর। বিশেষ করে মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের কথা বলছিলেন। কথা প্রসঙ্গে মাহমুদুল হক উসমানী বললেন, ‘মুজিবকে আমরা সঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা করিনি। তাঁর এমন কিছু মানবিক গুণ ছিল, যা খুবই রেয়ার (দুর্লভ)।’
উসমানী একটি দৃষ্টান্ত দিলেন। গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে আমরা সবাই বিভিন্ন দলের নেতারা পিন্ডিতে ছিলাম। শেখ সাহেব সবার সঙ্গেই খুব হাসিখুশিতে কথা বলেন। তাঁর হিউমার খুব চমৎকার ছিল। অনেক সময়ই মজা করতেন। তিনি পিন্ডি থেকে লাহোর গিয়েছিলেন। লাহোরে কী কাজ? শেখ সাহেব বললেন, বিচারপতি এস এ রহমানের সঙ্গে দেখা করতে।
যে বিচারপতি আগরতলা মামলার জজ ছিলেন, যাঁকে বাংলার মানুষ তাড়া করে ঢাকা থেকে এককাপড়ে বিদায় দিয়েছে, যাঁর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বাংলাদেশের মানুষ পুড়িয়ে ছাই করেছে, তাঁর সঙ্গে ওই মামলার প্রধান আসামির দেখা করার প্রয়োজন কী?
উসমানী বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘বিচারপতি রহমানের সঙ্গে কি কোনো প্রয়োজন ছিল?’
জবাবে বঙ্গবন্ধু উসমানীকে যা বলেন তা এ রকম: ‘বিচারপতি এস এ রহমান আগরতলা মামলার প্রধান বিচারক ছিলেন। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। মামলার শুনানির সময় প্রতিদিন আমি তাঁর মুখোমুখি হয়েছি। তিনি আমাকে উপযুক্ত সম্মান দিয়েছেন। কিন্তু আনরুলি মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) বলে একটা কথা আছে। তার ওপর কোনো নেতার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাদের থামানো যায় না। বিচারপতির বাসভবন পুড়িয়ে দিয়ে তাঁকে অসম্মান করে ঢাকা থেকে বিদায় করেছে আমার সমর্থকেরা। আমি তার জন্য বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম।’
উসমানী বললেন, শেখ সাহেব যে কাজটি করলেন, এই অঞ্চলের ভুট্টো বা আর কেউ তা করতেন না।
শুধু তা-ই নয়। যে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যবস্থা করেছিলেন, মামলা প্রত্যাহারের পর ইসলামাবাদে গিয়ে এক সন্ধ্যায় তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেন। তা ৫০ জনের পার্টি নয়। স্রেফ দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী একত্রে রাতের খাবার খান। সেই সময় তথ্যসচিব আলতাফ গওহর সেখানে থাকার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তাঁকে বলেন: ‘আপনার এখানে থাকার প্রয়োজন নেই, আপনি বাড়ি চলে যান।’
বঙ্গবন্ধুর জীবনী লেখার যখন উদ্যোগ গ্রহণ করেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তখন অনেকবার প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের কর্ণধার মোনায়েম সরকারের বাসভবনে আমাদের অনেকবার বৈঠক হয়েছে। কখনো কিবরিয়া সাহেব খেতে বলেছেন তাঁর বাড়িতে। তখন আমার জানা বহু ঘটনার কথা বলেছি। কোনো রাজনৈতিক নেতাকে শুধু তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে বিচার করা যায় না। তিনি মানুষটি কেমন ছিলেন, তা-ও বিচার্য।
এই কথাগুলো বললাম বড় বেদনায়। কিছুদিন আগে এক শিল্পপতি-ব্যবসায়ীর মেয়ে বা ছেলের বউভাতের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলাম। প্রায় সব দলের প্রধান নেতারা গেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমন্ত্রিতের সংখ্যাই বেশি। আমিও তাঁদের সঙ্গে বসেছিলাম একই টেবিলে। সেখানে দু-তিনটি চেয়ার খালি ছিল। বিরোধী দলের এক শীর্ষ নেতা গিয়ে তাঁদের সালাম দিলেন। ক্ষমতাসীনেরা মাথা নেড়ে শুধু ‘হু’ করলেন। খালি চেয়ারে তাঁকে বসতে বললেন না। বাক্যালাপ তো নয়ই। দৃশ্যটি আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে বললাম, তাঁকে বসতে বলা উচিত ছিল।
মানুষ রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার বা কলাম লেখক হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। মানুষের জন্ম যেমন মানুষ হিসেবে, তার মৃত্যুও হবে মানুষ হিসেবে। কেউ মন্ত্রী, কলাম লেখক বা ঠিকাদার হিসেবে মরে না। সুতরাং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে মানুষ হিসেবে থাকাই ভালো।
আজ ১০ জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে জবেহ করা হয় কত গরু-খাসি। বড় বড় ডেকচি উপচে পড়ে তেহারি ও রেজালায়। মাইক্রোফোন গর্জে ওঠে নেতাদের বক্তৃতায়। ১৯৭৩-এ প্রথম প্রত্যাবর্তন বার্ষিকীতে এই উপলক্ষে একটিমাত্র প্রতিবেদন করেছিল এই হতভাগাই। পঁচাত্তরের পর তো এ দিবস পালনের প্রয়োজনই ফুরিয়ে যায়। তবে ঘটা করে দিন পালনের চেয়ে নেতার জীবনাদর্শ পালনই বেশি প্রয়োজন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
mongsai79@gmail.com

Comments