‘রাখি বন্ধন’ আমাদের কোন বন্ধনে বাঁধছে?

‘রাখি বন্ধন’ আমাদের কোন বন্ধনে বাঁধছে?ঘুমে তার চোখ ঢুলুঢুলু। তবু সে ঘুমাতে যাবে না। অথচ সাতসকালেই স্কুলব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে তাকে ছুটতে হবে স্কুলে। বয়স কতই-বা হবে? ছয় কি সাত! কিংবা এর আশপাশে। সকালে এই বাবুটির ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে বিরাট এক ঝক্কি। মা প্রায়ই এ নিয়ে খিটিমিটি করেন। তেড়ে মারতে যান। কিন্তু এসবের কোনো পরোয়া নেই তার। ‘রাখি বন্ধন’ না দেখে কিছুতেই ঘুমাতে যাবে না সে। জাদু-বাক্সের এই সিরিয়াল যে তাকে জাদুর বন্ধনে জড়িয়েছে!

স্টার জলসার জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘রাখি বন্ধন’ এভাবে জাদুজাল বিস্তার করে চলেছে এ দেশের অগণিত খুদে দর্শকের মনে। যেসব শিশু সিরিয়ালটির নিয়মিত দর্শক, তাদের মায়েরা বলেন, এই সিরিয়াল শুরু হলে খুদে দর্শকদের টিভির সামনে থেকে নড়ানোই যায় না। তখন তাঁরাও বসে যান নিজের ছেলে বা মেয়ের পাশে। এভাবে তাঁরাও এখন নিয়মিত দর্শক।
স্টার জলসা, স্টার প্লাস বা জি বাংলার মতো ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের বাংলা সিরিয়ালগুলোর প্রতি এ দেশের দর্শকদের আকর্ষণ নতুন কিছু নয়। ঘরোয়া জীবনে অনেক দর্শকের এসব সিরিয়াল দেখার নেশা তো আসক্তির পর্যায়ে। বিশেষ করে নারী দর্শকদের বিরাট একটা অংশ এই আসক্তিতে মত্ত।
এ দেশে শহর আর গ্রামে এমন দর্শকও আছে, যে এক বেলা না খেয়ে থাকবে, কিন্তু স্টার জলসা বা স্টার প্লাসের কাঙ্ক্ষিত সিরিয়াল না দেখলে চলবে না। এ নিয়ে মারামারি, এমনকি আত্মহননের ঘটনাও ঘটেছে। গত ১৪ ডিসেম্বর প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে এমনই এক খবর প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘পছন্দের ভারতীয় সিরিয়াল দেখতে না পেরে আত্মহত্যা!’। খবরে উল্লেখ করা হয়, ফরিদপুর সদর উপজেলার একটি গ্রামে ভারতীয় সিরিয়াল দেখা নিয়ে দুই বোনের বিবাদের জেরে আত্মহত্যা করে কিশোরী ছোট বোন।
‘রাখি বন্ধন’ সিরিয়ালেরও রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। এই আকর্ষণ এখন কচি মনকেও স্পর্শ করেছে। শহর-বন্দর-গ্রামে যেখানে স্টার জলসার জাদুজাল রয়েছে, সেখানে অনেক খুদে দর্শক এখন উন্মুখ হয়ে থাকে—কখন রাত সাড়ে ১০টা বাজবে। বাংলাদেশের এই সময়টাতেই শুরু হয় ‘রাখি বন্ধন’। কেবল শিশুরাই নয়, সব বয়সী দর্শকই এখন আঠার মতো চোখ লাগিয়ে বসে এই সিরিয়াল দেখতে। এমনকি তিন বছরের শিশু, যার কাহিনি বোঝার মতো বোধ নেই, সেও এই সিরিয়ালে একেবারে চোখ বিঁধিয়ে বসে। ছোট্ট রাখি কী করে, একঠায় দেখে আর কুটকুট হাসে।
সংগত কারণেই প্রশ্ন এসে যায়, কী আছে ‘রাখি বন্ধনে’?
সিরিয়ালের কাহিনি মূলত রাখি ও বন্ধন নামের দুটি শিশুকে নিয়ে। বন্ধন ভাই। রাখি তার বোন। ওদের বাবা-মা নেই। জেঠু আর জেঠির কাছে থাকে। দাদামশাইয়ের বাড়ি। তবে সংসারটা এখন জেঠু-জেঠির। জেঠুর মুখ থেকে জানা যায়, রাখি-বন্ধনের মা-বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। শিশু হিসেবে রাখি একেবারেই ফুলের কুঁড়ি। বয়স পাঁচ কি ছয়। ভাই বন্ধন একটু ডাগর। ১২-১৩ বয়স। জেঠু-জেঠির ঘরে আবার দুই ছেলেমেয়ে। জেঠি চান নিজের মনের একলার সংসার, যেখানে রাখি-বন্ধনের মতো আপদ থাকবে না। জেঠু আবার ভাইয়ের ছেলেমেয়ের প্রতি একটা টান অনুভব করেন। হাজার হলেও তাঁর বংশধর। কিন্তু বউয়ের ভয়ে ভাইপো আর ভাইঝিকে দরাজ দিলে আদর করতে পারেন না। চুপিচুপি করেন। এদিকে পড়াশোনা করার সুযোগ না পাওয়া বন্ধনের লক্ষ্য একটাই—ছোট বোনকে খুব ভালো স্কুলে পড়াবে। মানুষের মতো মানুষ করবে। এখানে সেই স্কুল বলতে ব্যয়বহুল এক অভিজাত স্কুল দেখানো হয়েছে, যেখানে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট।
জেঠির নির্মমতা গল্পকাহিনির কুটিল সৎমা তো বটেই, ঠান্ডা মাথার খুনিকেও হার মানায়। গলগ্রহ বলে প্রতিভাত রাখি-বন্ধনকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে রাত-দিন নানা ফন্দিফিকির ঘুরপাক খায় তার মাথায়। ছোট ভাই মদনা তার যাবতীয় দুষ্কর্মের সহযোগী। এই দুজন মিলে রাখি আর বন্ধনের রোজকার জীবন নানাভাবে বিষিয়ে তোলে। এমনকি জেঠি চম্পা চামেলী দাস নামের এক নারী শিশু পাচারকারীর কাছে চড়া দামে রাখিকে বিক্রিও করে দেয়। একই সঙ্গে রাখি-বন্ধনের জন্য মা-বাবার রেখে যাওয়া ৪০ লাখ টাকাও হাতিয়ে নিতেও তার চেষ্টার ত্রুটি নেই। এদিকে চম্পা চামেলী আবার চড়া দামে ছোট্ট রাখির কিডনি বিক্রির ধান্দা করে সিরিয়ালে সাসপেন্সের খোরাক দিচ্ছে। মোটামুটি এভাবেই সিরিয়ালটির কাহিনি এগিয়ে চলেছে।
এটি যদি ছোটদের উপযোগী বিনোদনের বিষয় হতো, তাহলে কোনো কথা ছিল না। এ থেকে ছোটদের শেখার মতো যদি কিছু থাকত, তাহলেও কোনো প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু কাহিনি ও বিষয়বস্তু মিলিয়ে এটি মোটেও ছোটদের সিরিয়াল নয়। বড়দের সিরিয়াল। এর কাহিনিবিন্যাসে পদে পদে রয়েছে অবোধ শিশুর প্রতি মাতৃস্থানীয় দুই নারীর নির্মমতা, প্রবঞ্চনা, ছলচাতুরী, সুবিধা বাগানোর কারসাজি। আছে প্রতিকূলতা জয় করার নামে দুই শিশুর অবাস্তব লড়াই। আর আছে কিছু সস্তা ভাঁড়ামো।
সিরিয়ালের মূল আকর্ষণ রাখি নামের ছোট্ট শিশুটি। সে তোতাপাখির মতো টরটর করে কথা বলে। বড়দের অনেক বিষয়ে মন্তব্য করে জ্ঞান দেয়। এটা ঠিক যে রাখির কিছু আবেগপ্রবণ কথা প্রায়ই অনেক দর্শকের মন আর্দ্র করে তোলে। কিন্তু একজন পুরোহিত তাঁর মন্ত্রের অর্থ জানে কি না, এ প্রশ্ন তার কচি মুখে মানায় না। আরও মানায় না জেঠুর ‘আই লাভ ইউ’ সংলাপ আওড়ানো। পড়শি নারীর প্রেমে মজে রঙ্গরাজ জেঠু এটা বলেছেন।
এসব দেখে আমাদের সামনেই আমাদের শিশুরা অনেকটা জোয়ারে ভাসার মতো ‘পাকনা’ হয়ে উঠছে। খুঁজে দেখুন, অনেক শিশুই এখন একলা খেলার সময় রাখির মতো অভিনয় করে। তার বুলি আওড়ায়। তারা আরও কী শিখছে?
মা ছাড়া মাতৃস্থানীয় নারী যারা আছে, তারা বেশির ভাগই দয়ামায়াহীন প্রবঞ্চক, ফায়দা লোটা সুবিধাভোগী। আবার এটাও দেখছে যে জেঠুর মতো একজন ব্যক্তিত্ববান মুরব্বি কীভাবে ভদ্রতার লেবাস আবর্জনায় ছুড়ে পরনারীর সঙ্গে রংঢং করেন। তা আবার তাঁর এইটুকুন ভাইঝি রসে রসে সবাইকে বলে বেড়ায়। রাখির মাধ্যমে ছোটরা এই বার্তা পাচ্ছে যে মা-বাবা বাদে বড়রা বেশির ভাগই ভণ্ড, সুবিধাভোগী, নির্মম। এমন সিরিয়াল ছোটরা দীর্ঘদিন দেখলে কচি মনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে দেখা দিতে পারে আস্থার সংকট।
এটা বিশ্বায়নের যুগ। এখানে বিরাট ভূমিকা রাখছে আকাশ সংস্কৃতি। এর প্রভাবে আমরা হরদম যেমন বিজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি, তেমনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও কম ক্ষতি করছে না। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির বর্তমান প্রেক্ষাপট ভুখানাঙার মতো। এখানে নিয়মিত এমন কোনো ভালো চলচ্চিত্র হয় না, যা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে সব বয়সী দর্শকের নিয়মিত ভিড় থাকে। বলতে গেলে, চলচ্চিত্রের ব্যবসা এখন লাটে ওঠার জোগাড়। আমাদের নিয়মিত মঞ্চনাটক নেই। দেশের সব টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানই যেন একই ধাঁচ আর ছাঁচে চলে। নাটক-সিরিয়াল চলে গৎবাঁধা কিছু প্রেমকাহিনি আর টানাপোড়েন নিয়ে। আলাদা করার মতো কিছু খুঁজে পাওয়া দায়।
এ-ই যখন অবস্থা, তখন ‘রাখি বন্ধন’-এর মতো কোনো সিরিয়ালে তৃষ্ণার্ত দর্শকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়লে দর্শকদের আর দোষ দিয়ে কী হবে?
একটা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট গড়ে ওঠার চেয়ে সেটা ধরে রাখা খুব কঠিন। নিয়মিত চর্চা আর লালন না হলে যেকোনো সংস্কৃতি হারিয়ে যায়। আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম চর্চার মাধ্যমেই সংস্কৃতি হয় সমৃদ্ধ। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিজাতীয় সংস্কৃতি এসে আগ্রাসন চালায়। আর তা হয় সর্বভুক।
ঘরোয়া বিনোদনের জগতে আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা ‘আমার আমিত্ব’ খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, তাদের সামনে এ যুগের চলচ্চিত্রের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো সিনেমা নেই। দুহাতের মুঠোভরে সগর্বে দাঁড়ানোর মতো পর্যাপ্ত মঞ্চ ও টিভি নাটক নেই। অথচ একসময় ‘সকাল-সন্ধ্যা’, ‘ঢাকায় থাকি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘সংশপ্তক’, ‘অয়োময়’-এর মতো টিভি নাটক সব বয়সী দর্শক কত আগ্রহভরেই না দেখেছেন!
একটা সময় ছিল, যখন কোনো কিশোর বা তরুণ সিনেমা হলে যাওয়ার সুযোগ মিলত কালেভদ্রে। হলে গিয়ে সে যে ছবি দেখত, এতে থাকত পারিবারিক বন্ধন, মূল্যবোধ আর মিষ্টি প্রেম। এ ছবি দেখে কিশোর বা যুবা গোপন আবেগে ভাসত ঠিকই, কিন্তু কখনো ইভ টিজিং বা বখাটেপনার বিষবাষ্প ছড়ানোর সাহস করত না। আর বড়দের সামনে প্রেম-ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করা তো তখন রীতিমতো দুঃসাহস! এখন সিনেমা হলে যেতে হয় না। ঘরে ঘরে টিভি আর স্যাটেলাইট চ্যানেল। এখন ঘরে বসেই ছোট-বড় সবাই নানা ছবি দেখছে। হয়তো কোনো ছবিতে আচমকা কোনো ‘অবসিন’ এসে গেল, দেখা গেল বড়রাই না দেখার ভান করছে বা সরে যাচ্ছে, ছোটরা ঠিকই হাঁ করে তাকিয়ে সে দৃশ্য গিলছে!
মূল্যবোধের এই প্রেক্ষাপটে ছোট আর বড়র মান্যিগন্যির ব্যবধান এখন অনেকটাই কমে এসেছে। পরিণতিতে একদা লাজুক আর অপ্রতিভ কিশোর এখন হয়ে উঠেছে ভয়ংকর! ছোটখাটো অপরাধ বাদ দিয়ে তারা এখন খুন-ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে জড়াচ্ছে। ২৮ জানুয়ারি প্রথম আলো প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, নারী ও নির্যাতন এবং খুনসহ বেশ কিছু গুরুতর অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোরেরা। প্রতিবেদনে সমাজ পর্যবেক্ষকেরা কিশোরদের বখে যাওয়ার পেছনে যেসব কারণ দায়ী বলে উল্লেখ করেছেন, এর মধ্যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর স্যাটেলাইট চ্যানেল অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন।
এখন ‘রাখি বন্ধন’-এর মতো সিরিয়াল যেভাবে আমাদের শিশুদের টানছে, আর এই সুযোগে শিশুরা রাখির অপরিণত পাকামো, জেঠুর মুরব্বিগিরির আড়ালে ভাঁড়ামো আর জেঠিদের ডাইনিপনা দেখছে, এসবের আউলা বাতাস কচিমনাদের কোন জ্যাঠামোতে দাঁড় করায়, সেটাই এখন শঙ্কার বিষয়।
প্রশ্ন ওঠে, তবে কি শিশুরা এই সিরিয়াল দেখবে না?
শিশুমনে জোরজবরদস্তির ফল শুভ হয় না। এর চেয়ে বরং বিকল্প পথ খুলে দেওয়াই শ্রেয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর উচিত বেশি করে শিশুতোষ অনুষ্ঠান প্রচার করা। তা যদি আমাদের নিজস্ব ঘরানার হয়, নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ থাকে, তাহলে তো খুবই ভালো। আমাদের দেশে তো ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’, ‘দীপু নাম্বার টু’‍, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’-এর মতো ছবি হয়েছে, যে ছবিগুলো প্রশংসিত হয়েছে। জলাতঙ্কের সচেতনতা নিয়ে নির্মিত ‘ডানপিটে ছেলে’ সারা দেশের অগণিত দর্শকের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছে। 
মনে পড়ে, অনেক আগে বিটিভিতে একসময় ছুটির দিন সকালে প্রচার করা হতো শিশুতোষ ধারাবাহিক নাটক ‘রোজ রোজ’। তখন ঘরে ঘরে টিভি সেট ছিল না। যাদের বাসায় টিভি ছিল, প্রতিবেশী শিশুরা সকাল সকাল তাদের বাসায় এসে ঠিকই বসে যেত টিভির সামনে। সঙ্গে বড়রাও আসতেন। টিভি দেখার সঙ্গে চলত ঘরোয়া আড্ডাও। ‘রোজ রোজ’ নাটকের কাহিনিবিন্যাসে ছিল পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন, ছিল ভালো আর মন্দের তফাত, ছিল ছোটদের জন্য অনুসরণীয় অনেক কিছুই। আমরা সেই ‘রোজ রোজ’-এর মতো ধারাবাহিক নাটক কি রোজকার টিভি অনুষ্ঠানে রাখতে পারি না?
mongsai79@gmail.com

Comments