‘...মরিবার হল তার সাধ’

আপনার কাছে কি হিসাব আছে...মনে পড়ে ওয়েলিংটন, চট্টগ্রাম? এরও আগে মিরপুর, খুলনা...?
সাকিবকে সরাসরি প্রশ্নটা করা হয়নি। তবে সংবাদ সম্মেলনে যে সুরে কথা বলে গেলেন, তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার। মনে থাকা না-থাকায় কিছু আসে যায় না। কারণ তিনি মনে করেন, এটাই তাঁর খেলা। এভাবে খেলেই তিনি রান পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও এভাবেই খেলে যাবেন।
ফলো অন এড়াতে বাংলাদেশের চাই ৪৮৮ রান। সেই ‘বাতিঘর’ তখনো ২৭২ রান দূরে। মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে ১০৭ রানের জুটি হয়ে গেছে। ফিরে আসছে দুই টেস্ট আগে ওয়েলিংটনের স্মৃতি। এই দুজনের গড়া মহাকাব্যিক সেই ৩৫৯ রানের জুটি। সাকিব যেন ঠিক করলেন, আরও ভালোভাবে ওয়েলিংটনকে মনে করিয়ে দেওয়া যাক!
ওয়েলিংটনে পঞ্চম দিন সকালে বাঁহাতি স্পিনার মিচেল স্যান্টনারকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে যেভাবে মিড অনে ক্যাচ দিয়েছিলেন, যেন সেটিরই রিপ্লে। পার্থক্য বলতে এবার ঝুঁকিটা ছিল আরও বেশি। মারতে হয়েছে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের স্পিনের বিপরীতে। ম্যাচের ওই পরিস্থিতিতে কী ব্যাখ্যা আছে ওই শটের? ব্যাখ্যা বোধ হয় একটাই— ‘...মরিবার হল তার সাধ’!
ওয়েলিংটনের স্মৃতিটা একদম টাটকা। ‘ন্যাচারাল’ খেলার দোহাই দিয়ে সাকিবের আত্মহত্যার ঠিক আগের ঘটনাটাও বেশি দিন আগের নয়। ওয়েলিংটনের ঠিক এক টেস্ট আগেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে তৃতীয় দিন সকালে দ্বিতীয় বলেই মঈন আলীকে মাঠের বাইরে ফেলতে গিয়ে আউট হয়ে ফিরেছেন। ৫ উইকেটে ২২১ থেকে বাংলাদেশ ২৪৮ রানে অলআউট হয়ে যায়! ২২ রানে ওই টেস্ট হারার পর সাকিবের ওই ‘বন্য শট’টি হয়ে ওঠে আরও তাৎপর্যবহ।
বড় তাৎপর্য ছিল ওয়েলিংটনেও। প্রথম ইনিংসে ৫৯৫ রান করার পরও বাংলাদেশকে যে হারতে হয়েছিল, সেটির দায় অবশ্যই সাকিবের একার নয়। তবে ওভাবে আউট হয়ে এসেছেন বলে বড় দায়টা তাঁর ওপরই বর্তায়। পরিহাসই বলতে হবে, টেস্টটা অমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন সাকিবই। প্রথম ইনিংসে তাঁর ডাবল সেঞ্চুরির কারণেই নিউজিল্যান্ডে প্রথমবারের মতো কোনো টেস্ট ড্র করার সম্ভাবনা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ।
ব্যাটসম্যানরা বাজে শট খেলে আউট হতেই পারেন। আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাটা আরও বেশি। তাই বলে সর্বশেষ পাঁচ টেস্টে তৃতীয়বারের মতো এমন আত্মহত্যা! এমন ‘স্ট্রাইক রেট’ ক্রিকেট-বিশ্বের আর কোনো ব্যাটসম্যানেরই আছে বলে তো মনে হয় না। আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান কি তাহলে সাকিব একাই! সাকিবকে কিছু বলতে গেলে তা দেয়ালে মাথা কুটে মরবে। তিনি তো নির্বিকার মুখেই বলে গেলেন, ‘এগুলো নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ এটা আমার ন্যাচারাল খেলা। আমি এভাবেই খেলতে পছন্দ করি।’
নিউজিল্যান্ড সফর শেষে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেই বলেছেন, শেষ কবে বাজে বলে আউট হয়েছেন, এটি তাঁর মনে পড়ে না। সহকর্মী তারেক মাহমুদের নেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে একটা প্রশ্ন ছিল এ রকম: বাজে আউটগুলোর পর নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন, ওভাবে খেলাটা ঠিক হয়নি। এমন ক্ষেত্রে মনের ভেতরে তাৎক্ষণিক অনুভূতিটা কেমন হয়? সাকিব উত্তর দিয়েছিলেন: খারাপ তো লাগেই। কিন্তু এখানে কী করার আছে, বলুন?
আউট হয়ে যাওয়ার পর আসলেই কিছু করার থাকে না। কিন্তু একটা অনুশোচনা তো হয়। ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষাও। কাল ওভাবে উইকেট দিয়ে আসার পরও সাকিবের কথাবার্তা শুনে তাঁর একটুও খারাপ লেগেছে বলে মনে হওয়ারও কোনো কারণ নেই। দলের প্রয়োজনের কথা ভেবে কখনো একটু অন্যভাবে খেলার কথা ভাবেন কি না, প্রশ্নটার জবাব দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। তাচ্ছিল্যভরে শুধু দুপাশে মাথা নাড়লেন।
একবার এটাও বললেন, এভাবে না খেললে সাকিব নাকি আর সাকিব থাকবেন না। ‘এভাবে খেলা’ বলতে কী বুঝিয়েছেন, সেটি অবশ্য পরিষ্কার হলো না। শট খেলতে তো কেউ মানা করেনি তাঁকে। কিন্তু ম্যাচের পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী একটু কম ঝুঁকি নিলে এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে যে, সাকিব আর সাকিব থাকবেন না!
মিরপুর আর খুলনার কথাও বলা হয়েছে শুরুতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই দুটি টেস্টেও বাংলাদেশ ড্র করার স্বপ্ন দেখছিল সাকিবের ব্যাটে। খুলনায় বাঁহাতি স্পিনার পেরমলকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে নিজে সেঞ্চুরি (৯৭ রানে আউট) হারালেন, নিশ্চিত করে এলেন দলের পরাজয়ও। মিরপুরে ড্যারেন স্যামিকে স্কুপ মারতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ। ওখানেও বাংলাদেশের ভেঙে পড়তে এরপর খুব বেশি সময় লাগেনি।
বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ ইনিংসটি তাঁর। মনে রাখার মতো ইনিংসও কম খেলেননি। তারপরও সাকিবের একটি বাজে আউট কেন চোখের সামনে এমন একের পর এক আউট হওয়ার দৃশ্য সাজিয়ে দেয়? সেটি কি তিনি সাকিব আল হাসান বলে? বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটার বলেই? আর কারও ক্ষেত্রে তো চাইলেও এমন একের পর এক উদাহরণ মনে পড়ে না!
একটা কারণ হয়তো সাকিব এমন জায়গায় ব্যাটিং করেন যে, ভরসার শেষ শিখাটা তাঁকে ঘিরেই জ্বলে। তাঁর বাজে আউটের রেশ ধরেই বাংলাদেশ ভেঙে পড়ে বলে তা এমন মনে গেঁথে থাকে। টেস্টের কথা বলতে বলতেই যেমন মনে পড়ে গেল গত অক্টোবরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের কথা। সাকিব এমন অসাধারণ ব্যাটিং করছিলেন যে, কে বোলার-কেমন বল তাতে যেন কিচ্ছু এসে যাচ্ছিল না। কিন্তু ম্যাচটা যখন হাতের মুঠোয়, তখনই অকারণ উচ্চাভিলাষী এক শট খেলে আউট হয়ে এলেন। জেতা ম্যাচটা হেরে গেল বাংলাদেশ!
সাকিবের ক্রিকেটিং মস্তিষ্ক খুব প্রখর। এমন হতেই পারে না, ব্যাটসম্যানশিপের বড় কথা যে কখন ঝুঁকি নেওয়া যাবে, আর কখন নয়, এটা তিনি বোঝেন না। বিরাট কোহলিকে তো মাত্রই একটা ডাবল সেঞ্চুরি করতে দেখলেন। শট কোহলিও তাঁর চেয়ে কম খেলতে পারেন না। কিন্তু তাঁকে দেখে কখনো কি মনে হয়েছে, বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিচ্ছেন! টানা চার সিরিজে কোহলির চার ডাবল সেঞ্চুরি। এই চার ডাবল সেঞ্চুরিতে ছক্কা মাত্র একটি। ছক্কা মারতে পারেন না—কোহলিকে নিশ্চয়ই এই অপবাদ কেউ দেবে না।
চ্যাম্পিয়নদের অহম থাকে। সাকিব যে চ্যাম্পিয়ন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও অহমটা ঝেড়ে ফেলে একটু যদি ভাবেন, তাতে শুধু দলের মঙ্গল নয়, তাঁরও মঙ্গল।
mongsai79@gmail.com

Comments