পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ সেটেলারদের পুনর্বাসিত করার চেষ্টা চলছে

পার্বত্য চট্টগ্রামে আশি ও নব্বইয়ের দশকে সেনাবাহিনী ও শান্তি বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যাঁরা উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের নিজেদের বাড়িঘরে পুনর্বাসনের জন্য তৈরি তালিকায় পুনর্বাসিত (সেটেলার) বাঙালিদেরও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এই চেষ্টা চলেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

একইভাবে ওই সময় যাঁরা ভারতে শরণার্থী হয়েছিলেন এবং ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে চুক্তির পর ফিরে এসেছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের তালিকায়ও এমন কিছু নাম ঢোকানোর চেষ্টা হচ্ছে, যাঁরা চুক্তি সইয়ের আগেই দেশে ফিরেছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ওই অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের শর্ত রয়েছে। সে জন্য তাঁদের চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের বিধান রাখা হয়। চুক্তি সইয়ের পর অনেকবার সেই টাস্কফোর্স গঠন ও পুনর্গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত শরণার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। তাঁদের পুনর্বাসনও হয়নি। ফলে তাঁরা এখনো কার্যত উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর জীবনই যাপন করছেন।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার জামতলি নোয়াপাড়ার প্রত্যাগত শরণার্থী পুনর্বাসন এলাকার অভিলাষ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ভারতে শরণার্থী হয়েছিলেন। ফিরে এসেও শরণার্থী হয়ে আছেন। জমি-বাড়ি বেদখল হয়ে আছে। ভূমি কমিশন যদি তা ফিরিয়ে দেয় তাহলে তাঁর এই অবস্থার অবসান হতে পারে।

একই পাড়ার মন্ময় চাকমা বললেন, তিনি প্রায় ১৯ বছর নিজ দেশে উদ্বাস্তু অবস্থায় আছেন। তাঁর বাড়ি-জমিও অন্যের দখলে।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো প্রথম আলোকে বলেন, যুদ্ধকালীন অবস্থায় পাহাড়িদের অনেক বাড়িঘর, জমি-বাগান সরকার সেটেলারদের কবুলিয়ত দলিল করে দেয়। তখন সেই সব বাড়ি থেকে অনেক পুনর্বাসিত বাঙালিও সরে যেতে বাধ্য হন। তাঁদের অনেকে চুক্তির পরও সেখানে ফিরে আসেননি বা আসতে পারেননি। সেই কবুলিয়ত দলিল দেখিয়ে তাঁরা এখন উদ্বাস্তু হিসেবে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর গত ১৯ বছরে পুনর্বাসিত বাঙালিদের অনেকেই জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এই দলগুলো বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। যে দল যখন ক্ষমতায় এসেছে সেই দলের সমর্থকেরা তখন চেষ্টা করেছেন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর তালিকাভুক্ত হওয়ার। ফলে তালিকা চূড়ান্ত করা যায়নি। এখনো সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। রাজনৈতিক দলগুলো ভোট বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই চেষ্টায় পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার নাসিরউদ্দিন ১৯৮০ সালে সেটেলার হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম আসেন। তখন কবুলিয়ত দলিল করে তাঁর পরিবারকে জায়গা দেওয়া হয়েছিল পানছড়িতে। বছরখানেক পর যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তিনি সেখান থেকে মঠবাড়িয়ায় চলে যেতে বাধ্য হন। আবার বছরখানেক পরে তিনি পরিবারসহ ফিরে এলেও পানছড়িতে যেতে পারেননি। তিনি তখন খাগড়াছড়ি শহরের এক প্রান্তে বসবাস শুরু করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর টাস্কফোর্স কাজ শুরু করলে তিনি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছেন বলে প্রথম আলোকে জানান।

বরগুনা জেলার পাথরঘাটার মান্নান হাওলাদার এখন বসবাস করেন গুইমারা উপজেলার হাফছড়িতে। তিনি ১৯৮২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে যাওয়ার পর সরকার কবুলিয়ত করে জায়গা দেয় বড়পিলাক নামক স্থানে। জায়গাটি তখন খুব দুর্গম ছিল। তাই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেখান থেকে তিনি চলে আসেন হাফছড়িতে। এখানকার জায়গার কোনো বরাদ্দ তাঁর নামে না থাকলেও তিনি বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। অনেক বড় আমবাগান করেছেন। আরও অনেক ফল-ফসল ফলাচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সব সময়ই তাঁর আশঙ্কা ছিল, যদি কখনো এই জায়গার মালিক ভূমি কমিশনের রায় নিয়ে চলে আসেন, তখন তিনি যাবেন কোথায়। তাই আগে থেকেই চেষ্টা করছেন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু তালিকায় নাম লিখিয়ে পুনর্বাসিত হওয়ার।

অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত শরণার্থী পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্সের একটি সূত্র জানায়, নাসিরউদ্দিন ও মান্নান হাওলাদারের মতো সেটেলারদের চেষ্টা এড়িয়ে যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য এখন উপজেলাভিত্তিক কমিটি করে কাজ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে তার ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পরিবারের সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো হতে পারে। শিগগিরই এই তালিকা চূড়ান্ত করা যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টাস্কফোর্সের এই সূত্র জানায়, প্রত্যাগত শরণার্থীর তালিকা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। টাস্কফোর্স সর্বমোট ১২ হাজার ২২২টি পরিবারকে প্রত্যাগত শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার সদস্য প্রায় ৭০ হাজার। তবে আরও কিছু পরিবার নিজেদের প্রত্যাগত শরণার্থী বলে দাবি করছে। কিন্তু টাস্কফোর্স নিশ্চিত হয়েছে যে তাঁরা ভারতে শরণার্থী হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হওয়ার আগে বিভিন্ন সময় স্বেচ্ছায় দেশে চলে এসেছেন। তাই তাঁদের প্রত্যাগত শরণার্থীর তালিকাভুক্ত করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত টাস্কফোর্স নিতে পারবে না। সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে। বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে উপস্থাপন করা হয়েছে ।
mongsai79@gmail.com

Comments