বেঁচে আছে মারমা দুই বোন আর জুম খেত

কিশোরী দুই বোন বেঁচে গেছে সৌভাগ্যবশত। ওরা কেউ সেদিন বাড়িতে ছিল না। বেঁচে থাকার কারণ নিঃসন্দেহে তাই। কারণ, খাড়া পাহাড়ের গায়ে ওদের বাড়ি নামের যে স্থাপনাটি ছিল, ঠিক এক মাস আগে পাহাড়ধসের কারণে তা এখন মাটির স্তূপ। আর তাতে যেসব প্রাণ ছিল, তার একটিও বেঁচে নেই।
বাড়িটিতে ছিলেন ওদের বাবা-মা, এক ভাই ও এক বোন। তাদের সবাইকে এই মাটির স্তূপের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে—মৃত। আর তিনটি ছাগল, দুটি শূকর ছিল গৃহপালিত। সেগুলোও মৃতই পাওয়া গেছে।
আনুমা ও ওয়াইচিং মারমা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতে এরা এখন নির্বাক। রাঙামাটি কাউখালি উপজেলার ১ নম্বর বেতবুনিয়া ইউনিয়নের নয় নম্বর ওয়ার্ডের রাউজান ঘোনায় তাদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের স্থান থেকে মঙ্গলবার দুপুরে ছবিটি তোলা। ছবি: সুপ্রিয় চাকমাস্বজন হারিয়ে সৌভাগ্য যাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই দুই বোনের নাম আ নু মা মারমা (১৪), আর ওয়াই চিং মারমা (৯)। তাদের গ্রাম বেতবুনিয়া ইউনিয়নের রাউজান ঘোনায়। শুধু এ গ্রামে নয়, আশপাশের এলাকায় ওদের বেঁচে যাওয়ার গল্প মুখে মুখে। গতকাল মঙ্গলবার রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার গ্রামটিতে যখন গেলাম, তখন আকাশ মেঘলা। আগের রাত থেকে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। বেতবুনিয়া বাজার থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে রাউজান ঘোনা। ইট বিছানো পথের নানা জায়গায় গত ১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড়ধসের চিহ্ন স্পষ্ট। কোথাও রাস্তার পাশেই মাটির ছোট ঢিবি, রাস্তার পাশে দুমড়ানো গাছ পড়ে আছে কোথাও। রাস্তা কোথাও এমনভাবে ভেঙেছে, মনে হচ্ছে যেন কেউ খাবলা দিয়ে তা তুলে নিয়ে গেছে। পাহাড়ি রাস্তার পাশে গভীর খাদ। রাস্তার পাশেই স্থানীয় কয়েকজন মানুষসহ এই দুই কিশোরী দাঁড়িয়ে ছিল।
আ নু মা মারমা সেদিন বাড়িতেই ছিল না। ও ছিল কক্সবাজারে। সেখানে এক অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয়ের পরিবারের সঙ্গে থাকে সে। আরেক বোন ওয়াই চিং চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সে বাংলাটা ঠিকমতো বলতে পারে না। সেদিনের ঘটনা মারমা ভাষায় সে যা বলল, তার সারকথা—ও থাকত পরিবারের সঙ্গেই। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার দিকে পড়তে গিয়েছিল পাড়ার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল বলে বাড়িতে আর ফেরেনি। ওয়াই চিং বলে, ‘সেদিন বাড়ি থাকলে আর হয়তো বাঁচতাম না।’
আ নু মা মারমা মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে কথা বলত মা-বাবার সঙ্গে। ঘটনার দিন অবশ্য কোনো কথা হয়নি। কথা বলেছিল দুদিন আগে। সে বলল, ‘বাবা জানতে চাইল কবে আসব। ছোট ভাই কক্সবাজার যেতে চেয়েছিল আবার। এরপর আর কোনো কথা হয়নি।’
ওই দুই কিশোরী আরও কয়েকজন মিলে আমরা এগোলাম তাদের বাড়ি দেখতে। পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে নেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নামলাম নিচের দিকে। আবার উঠতে হলো একটি ছোট পাহাড়ে। সেখানে লাল মাটির স্তূপ। এটিই তাদের বাড়ি ছিল। সেই স্তূপে ‘উঁকি দিচ্ছে’ বালিশ, কাঁথা, একটি ঘটি, লেপ, চাটাই, মশারি। ঘুমের মধ্যেই বাড়িটি অন্তত ৩০ ফুট নিচে এসে পড়েছে। সেখানে গোটা তিন-চারেক টিনও আছে। লাশগুলো উদ্ধার করে এসব টিনের ওপরই রাখা হয়েছিল। কিশোরী দুটির কাকাতো ভাই কে অ চিং কারবারি জানালেন এসব কথা। বললেন, সেদিন ভোরে তিনি খোঁজ নিতে বেরিয়েছিলেন কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি না। ওই বাড়ির কাছে গিয়ে দেখেন, বাড়িটি ধসে মাটির স্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল তখনো। এর মধ্যে আশপাশের লোকজনকে তিনি ডেকে আনেন। তারপর এক এক করে বের করা হয় লাশ।
কিশোরী দুটি ধ্বংস হওয়া ঘরের পাশে দেখাল, কোথায় ওরা থাকত, কোথায় থাকতেন বাবা-মা, আর কোথায় ছিল তাদের রান্নাঘর। ওয়াই চিং কাছেই ছিল বলে সকালেই জানতে পারে ওই ভয়াবহ ঘটনার কথা। আর আ নু মা মারমাকে বিষয়টি জানায় ওকে আশ্রয় দেওয়া আত্মীয়রা। পরদিনই সে চলে আসে কক্সবাজার থেকে। বাবা-মাকে দেখতে পায়নি সে। ও আসার আগেই বাবা, মা, ভাইবোনের শেষকৃত্য হয়। আ নু মা মারমা বলে, ‘বাবা-মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে। বারবার বাড়ির কাছে আসি। কিন্তু বাবা-মাকে পাই না।’
এই দুই কিশোরীর বাবা খেইচি মারমা পেশায় জুমিয়া (জুম চাষি)। পাহাড়ের গায়ে নানা ধরনের ফসলের সমন্বিত চাষ হলো জুম। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করতেন স্ত্রী চে মো মারমা। দিন দিন পাহাড়ে জুমের জমি কমে যাচ্ছে। বেতবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান খোইচাবাই তালুকদার বলেন, ‘সংরক্ষিত বন ঘোষণার ফলে পাহাড়ি জুমিয়ারা দিন দিন জুমের জমি হারাচ্ছে। নতুন জায়গা সন্ধানে তাদের বেছে নিতে হচ্ছে দুর্গম জায়গা।’
দরিদ্র পরিবারটিও বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন জুমের কারণেই এ দুর্গম অঞ্চলে বাসা গড়ে। পাহাড়ধস সেই বাসা নিশ্চিহ্ন করেছে। কেড়েছে চারটি প্রাণ। এই বাড়িটির ঠিক ওপরের পাহাড়েই জুমচাষ করেছিল পরিবারটি। এখন ভরা বর্ষায় লকলক করে উঠছে সবুজ ধানের চারা আর সঙ্গের অন্য ফসল। প্রাণহীন বাড়িটির ধ্বংসস্তূপ থেকে সেই জুমের খেত স্পষ্ট চোখে পড়ে।
mongsai79@gmail.com

Comments