ফেসবুকের দংশন থেকে সাবধান!

কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে অয়ন। বছর দেড়েক পরই গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা, যে পরীক্ষার ওপর নির্ভর করছে তার জীবনের মোড়। কিন্তু পাঠে মন নেই অয়নের।
অয়নের একটি মুঠোফোন আছে। গত জন্মদিনে অনেক কসরত করে মায়ের কাছ থেকে বাগিয়েছে। স্মার্টফোন! এটা ওর কাছে আলাদিনের চেরাগের চেয়েও দামি। আলাদিনের চেরাগে তো ঘষা লাগে, এটায় তা-ও লাগে না। মসৃণ পৃষ্ঠদেশে আলতো পরশ বোলালেই বিরাট জাদুর দুনিয়া খুলে যায়। এর নাম ফেসবুক। কলেজের টেক্সট বুক শিকেয় তুলে আপাতত এই ফেসবুক নিয়েই দিন কাটছে তার।

অয়নের শয়নে-স্বপনে এখন ফেসবুক। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই বুকের ভেতর ফেসবুক মায়াপুরীর জাদুকাঠির মতো নাচে। ‘আয় আয়, সোনা জাদু’ বলে হাতছানি দেয়। এ ডাকে অয়ন পাগলপারা। সুযোগ খোঁজে কখন বড়দের নজর এড়িয়ে করতলে আনা যাবে সেই জাদুর যন্ত্র। দেওয়া যাবে স্ট্যাটাস, পোস্ট করা যাবে নিজেরই নায়কের মতো পোজ দেওয়া ছবি, আর পাওয়া যাবে লাইক। বন্ধু তালিকায় কয়েকজন মেয়েও আছে, যাদের সঙ্গে চ্যাট করার মজাই আলাদা! কিন্তু দুরবিনের মতো চোখ বিঁধিয়ে রাখা মুরব্বিদের জ্বালায় সে সুযোগ কি আর জোটে?
এ ভাবনায় অয়নের ধরণি উতলা। মা কী বলছেন, কানে যাচ্ছে না। আর বাবা তো এখন শত্রু। খালি পড়তে বলেন। ফেসবুকের ওপর কোনো ‘বুক’ আছে নাকি? আর স্কুলের শিক্ষকেরা কী যে ছাই বক বক করেন, কানে যেন পোকা মারার তরল বিষ ঢালেন! স্যাররা তো আর বোঝেন না—ফেসবুক পাঠে কী যে মজা!
এই করে করে অয়নের পরীক্ষা এসে যায়। মা ভাবেন, ঘাড় গুঁজে বসে থেকে ছেলে তাঁর ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে বিদ্যার্জন করেছে, পরীক্ষার হলে গিয়ে উগরে দিলে খাতা সয়লাব। বাবা ভাবেন, না, ছেলে এবার বোমার মতো নাম ফাটাবে। কিন্তু বইয়ের তলে মুঠোফোন রেখে ছেলে যে ফেসবুক মকশো করে পাঠের ঝোলা উজাড় করেছে, এর খোঁজ তো তাঁরা পাননি। সোনার ছেলে অয়নের এই যদি পাঠের অবস্থা, তবে পরিণতি কী? এ প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা।

এতক্ষণ যে অয়নের কথা বললাম, এটা কাল্পনিক চরিত্র। তবে ঘটনা কিন্তু অবাস্তব নয়। এমন অয়নের বিচরণ এখন চারদিকে। স্মার্টফোনে মোহাবিষ্ট এসব অয়ন ইন্টারনেটের মায়াজাল আর ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের প্যাঁচকলে আটকে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শহর-বন্দর-গ্রাম—কোথাও এই আসক্তি কম নেই; বরং দিন দিন ব্যবহার বাড়ছে।

সম্প্রতি এক চক্ষু চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে এমন একটি ছেলের দেখা মিলেছে। ছেলেটি সামনে এসএসসি দেবে। তার সমস্যা, পড়তে বসলে মাথা ঘোরায়, চোখে ঝাপসা দেখে। ক্ষুধামান্দ্য আছে। সকালে দেরিতে নাশতা করে। এতে উদ্বিগ্ন মা-বাবা। তাঁরা দুজনই ছেলেটিকে নিয়ে এসেছেন। চিকিৎসক চোখ পরীক্ষা করে কিছু না পেয়ে ছেলেটিকে উকিলের মতো জেরা শুরু করলেন। বেরিয়ে এল আসল ঘটনা। ছেলেটি রাত জেগে ইন্টারনেট ঘাঁটে। ফেসবুক নাড়াচাড়া করে। এতে তার প্রচুর প্রাণশক্তি খরচা হয়। অনেক রাত অবধি জেগে মায়ের তাগিদে ভোরে উঠতে হয় বলে দিনটা শুরুই হয় নিমতেতো আমেজে। মোটে একটা শরীর এত ধকল সইবে কেন? এ জন্য মাথা ঘোরানো আর চোখে ঝাপসা দেখার মতো উপসর্গের আবির্ভাব।

কিছু অভিভাবক আছেন, যাঁরা আগে থেকেই সচেতন। তাঁরা ছেলের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়ার বিপক্ষে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তই-বা কতটুকু ঠিক? অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যখন ঘরের ভেতর উপাদেয় খাবারের মতো সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে, এর স্বাদ নেওয়া থেকে ছেলে বা মেয়েকে কতক্ষণ বিরত রাখা যাবে? আবার সুযোগ দিলেও মরণ! এতে আসক্তি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি ষোলো আনা। আর আধুনিক প্রযুক্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে দূরে ঠেলে রাখাও তো সমীচীন নয়। তবে কি আমরা ফেসবুককে গলা ফাটিয়ে গাল দেব? ফেসবুকওয়ালের গোষ্ঠী উদ্ধার করব?
করেইবা কী লাভ? অনেক ক্ষেত্রে অগ্রপথিক তো বড়রাই। এমন পরিবারও আছে, যেখানে মা-বাবা উভয়েই ফেসবুক ছাড়া চলতে পারেন না। বাবা ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুক খুলে দেখছেন দিনদুনিয়ার খবর। এর-ওর খোঁজ নিচ্ছেন। মা ফেসবুক খুলে ঘাঁটেন গৃহস্থালির নতুন গেজেট কী বেরোল, রান্নাবান্নার নতুন রেসিপি কী। মা-বাবার এই অবাধ তৎপরতায় তলে-তলে সন্তানও উৎসাহিত হয়।

এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক খুবই ভালো। এর মাধ্যমে নতুন নতুন যোগাযোগ বাড়ে। চেনা-অচেনা অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। দুনিয়ার নানা প্রান্তের নানা খবর পাওয়া যায়। জানা যায় নতুন নতুন বিষয়। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাবও তো কম নয়। বিশেষ করে কাঁচা মাথায় এর আসক্তি ভয়াবহ। সে ক্ষেত্রে কী করণীয়?
এ ক্ষেত্রে সচেতনতা, সতর্কতার বিকল্প নেই। সাপ এমন এক প্রাণী, একটা শিশু জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জানতে পারে—বুকে হাঁটা এই প্রাণীর বিষ আছে। সাপের ছোবলে অন্য প্রাণী মারা যায়। কাজেই সাপ নিয়ে একজন মানুষ শৈশব থেকেই সচেতন। সাপ ভয়ংকর ঠিকই, তবে তার উপকারিতাও কম নয়। সাপ কৃষিজমির পোকামাকড়-ইঁদুর খেয়ে কৃষকের ফসল রক্ষায় বিরাট উপকার করে। সাপের বিষ ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। কিছু মানুষের উপাদেয় খাবারের তালিকায় রয়েছে সাপ। বেদে বা সাপুড়ে সম্প্রদায়ের রুটিরুজির মূলেই তো সাপ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও সাপের ভূমিকা কম নয়।

সে রকম ফেসবুকের ভালো জিনিসটা নিতে আমাদের তো কোনো সমস্যা নেই। উপকার আমরা যতটা পারি নেব। আর ক্ষতিকর দিক, যা বিষাক্ত দংশনের মতো সর্বনেশে, তা থেকে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। সচেতন করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। 
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক, সাংবাদিক
ঘরে বসে আয় করতে চাইলে নিচে লিং এর গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে এখুনি কাজ শুরু করুণ http://zummoney.club/427307561519/

Comments