বুক আমার, তারে কতটুকু ঢাকবো সে আমার ইচ্ছেধীন ! – শারমিন শামস্

“খালি শরীর আর শরীর। বুক আর বুক। পিরিয়ড আর পিরিয়ড, অর্গাজম আর অর্গাজম..এই কি নারীবাদ? উফফফ”
তো আর কি! ভাবসিলাম লিখবো না। পরে মনে হল, একেবারে ছেড়ে দেবার কিছু নাই। বিশেষত রূপা নামের মেয়েটিকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে ঘাড় মটকে হত্যার ঘটনাটা যখন চোখে পড়লো, তখন ভাবতেই হচ্ছে, যৌনতা আসলে কার মাথায় উঠে দপদপাচ্ছে? এদেশের পুরুষের নাকি এই যুদ্ধ করে বেড়ানো নারীবাদীদের? আর কেনই বা এই যুদ্ধ?
প্রথমেই বলি, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীকে তার যুদ্ধ শুরু করতে হয়েছে শরীর থেকেই। কেননা, সমাজ তাকে শরীর হিসেবেই জেনে এসেছে, শরীর বলেই স্বীকৃতি দিয়েছে, আর কিছু নয়। নারী একটি আপাদমস্তক শরীর, যা শুধু পুরুষের ভোগ আর সেবার কাজে লাগবে- এই হল সমাজে পুরুষতন্ত্রের চিন্তার মূল জায়গাটা। তো অবস্থা যখন এই, তখন শরীর নিয়েই তো যুদ্ধের সূচনা হবে, নাকি? এই শরীরই তো নারীকে ভোগের, ত্যাগের, অত্যাচারের, নির্যাতনের, ধর্ষণের বস্তু বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে শরীর কীভাবে বাদ যাবে?
এই যে রূপা নামের মেয়েটি ধর্ষণের পর খুন হলো, কেন হলো? শরীরের জন্যই তো হলো। শরীর মানে তার একটি যোনী, সেটাই তো চেয়েছে ধর্ষক খুনিরা। রূপার শিক্ষা দীক্ষা, চাকরি, উপার্জন, স্বনির্ভরতা- কোন কিছু কি এখানে ম্যাটার করেছে? বাসের অশিক্ষিত হেলপার, ড্রাইভার মিলে তাকে রেইপ করে ঘাড় মটকে মেরে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে লাশ। এখন রেইপ করে পুরুষ, ধর্ষিত হয় নারী, তারপর সেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে নারীবাদী লেখকরা কলম তুললেই পিনাকী, টিনাকী, মিনাকি কী হানাকিরা বলতে শুরু করেন, নারীবাদীরা সারাক্ষণ শরীরের কথা বলছেন?
ভাইরে, ধর্ষণ তো তুই করলি শরীরটাকেই! সেক্স তো উঠলো তোমাদের মাথাতেই! সেই উপরে ওঠা সেক্সের বিরুদ্ধে কলম ধরতে গেলে আমাদের আর কীভাবে ঘুরিয়ে অন্য কোন কাব্যিক ভঙ্গিতে কথা বলতে হবে, প্লিজ একটু শিখিয়ে দেবেন কি?
পিনাকী, চাকাকি, টুনাকি বলেন, প্রান্তিক নারীদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে কথা না বলে আমরা বলছি শরীরের কথা।
প্রান্তিক নারীদের কষ্টের উৎসটা কী? কষ্টগুলো কী কী? কর্মক্ষেত্রে নারী শারীরিকভাবে দুর্বল, এই ভুল মিথ্যে তথ্য দিয়ে ক্রমাগত তাকে কম মজুরি দেয়া হয়, তার প্রমোশন আটকে দেয়া হয়, গর্ভাবস্থায় তাকে কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়, গর্ভকালীন কোন সুবিধা তাকে দেয়া হয় না- এখন এই নিয়ে কথা যে বলবো, তাতেও তো তোদের আপত্তি উঠবে, কিন্তু এই কথাগুলোও তো শরীরেরই।
একজন বললেন, “সারাক্ষণ বুক বুক বুক”।
সত্য। বুক নিয়ে আমরা কথা বলি। কেন বলি ভাই? এই বুকের দিয়ে তাকায়া, বুকের জন্য ফ্যান্টাসি করে করে শহীদ হচ্ছেন আপনেরা, না পেয়ে অবদমিত কামে অস্থির হয়া অশ্লীল বাক্যবাণে রাস্তায়-ঘাটে, হাটে বাজারে, অনলাইনে মেয়েদের যা তা বলেই চলেছেন। বুক সংক্রান্ত কথার তোড়ে আমরাই তো জেরবার হয়া এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি, বুক আমার, তারে কতটুকু ঢাকবো সে আমার ইচ্ছেধীন। এখন হেইডাও বলা যাবে না। বললেই আমরা যৌনতাবাদী। আরে ভাই, মাতৃদুগ্ধ উৎপাদনের অঙ্গরে আপনেরা সেক্স অর্গান বানায়া তুমুল ফ্যান্টাসির ভিত্রে দিনযাপন করতেসেন। সেইটা থেকে বের হইতেই তো কইতেসি আপনাদের। বাইর হোন। মানুষ হোন।
তারপর শুরু হইসে পিরিয়ড। আরে ভাই, রোজার দিনে আপনেরাই তো মেয়েদের জিগান পিরিয়ডের কথা। রোজা নাই শুনলে শরীর দুলায়া হাসেন। এখন বলেন তো, তাইলে পিরিয়ড নিয়া কথা না বললে ক্যামনে আপনাদের এই খাসলত দূর করবো? আপনেরাই কন!
এখন আসি আসল জায়গায়। যৌনতা। নারীবাদ নারীর যৌন স্বাধীনতার কথা বলে, অর্গাজমের অধিকারের কথা বলে। এইডাতে আপনাদের এত বিরাগ ক্যানো? নাকি ঠিকমত অর্গাজম দিতে না পাইরা দিনের পর দিন যেমন আরামে কেটে যাচ্ছিলো, আজ সেই বাড়া ভাতে হঠাৎই ছাই পড়েছে টুপ করে? এতদিন মেয়েরা চুপ করে মেনে নিয়েছে পাশে শুয়ে থাকা স্বামীর পুরুষত্বহীনতা। নারীবাদ নারীকে জানিয়েছে, এটি মেনে নেয়া মানে অসুস্থ জীবন যাপন করা। নারীর অধিকার আছে অর্গাজম পাবার। এবং সেক্স জীবনের একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ, একে অস্বীকার বা ছোট করে দেখবার কিচ্ছু নেই। বরং এটি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
পুরুষের যৌন স্বাধীনতাকে সমাজ মেনে নিয়েছে। পুরুষের বহুবিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছে সমাজ ও ধর্ম। পুরুষের পতিতালয়ে গমনের পথকে রাষ্ট্র সুগম করেছে। কিন্তু নারীবাদ পুরুষের এই যৌনস্বেচ্ছাচারকে চ্যালেঞ্জ করেছে। নারীকে প্রতিবাদী হতে শিখিয়েছে। এখন আপনাদের এই যৌনস্বেচ্ছাচারিতার কথা বলে প্রতিবাদ জানানোর জন্য যা কিছু লেখা, সেসবে অবধারিতভাবে যৌনতা আসবে। যৌনতাই যেখানে নির্যাতনের মূল অস্ত্র, সেখানে যৌনতাকে আপনি এড়াবেন কীভাবে?
ধর্ষণ, ইভ টিজিং, যৌন হয়রানি করে করে অতীষ্ট করে তুলেছেন এদেশের নারীদের। ঘরে স্ত্রীকে নানাভাবে অত্যাচার করছেন, বিছানায় স্বেচ্ছাচার করছেন। এখন নারী তার দীর্ঘদিনের নীরবতাকে ভেঙ্গে মুখ খুলেছে। মুখ খুলেছে বলেই বেরিয়ে আসছে শত শত বছরের অন্ধকারের ইতিহাস। আপনাদের যৌনতার বলী এদেশের নারীরা। আজ নারী যখন তার শরীরের প্রতি সমাজের, এদেশের অধিকাংশ পুরুষের লোলুপ দৃষ্টিকে চ্যালেঞ্জ করছে, যৌন জীবনের সুস্থতা আর সৌন্দর্যের জন্য লড়াই করছে, তখন আপনাদের মাথা গেছে খারাপ হয়ে।
কেন ভাই? অন্ধকারের গভীরে আপনাদের লাম্পট্য আর নপুংসতার কাহিনীগুলো বেরিয়ে আসছে বলেই কি এতো রাগ, এতো ভয়? যে লাম্পট্য আর অক্ষমতা দিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়ে গেছেন নারীকে, আজ কি সেসব হাত ফসকে যাবার ভয়টাও যুক্ত হয়েছে সাথে?
জ্বী, আমি জোর গলায় বলছি, হ্যাঁ, আপনাদের সাথে গলা মিলিয়েই বলছি, এদেশের নারীবাদ নারীর শরীর আর যৌনতার কথাই বেশি বলে। জ্বী বলে। কারণ এদেশের নারীর জীবন এখনও ওই দুটি মোড়কে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছে। নারীর জীবনে তার শরীরই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। শরীরের জুজু দেখিয়েই তার সাথে বৈষম্য করা হয়, তাকে নির্যাতন করা হয়, তাকে বঞ্চিত করা হয়।
তাই শরীর আর যৌনতা সংক্রান্ত সব ধরনের ট্যাবু থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এদেশের নারীকে। সবার আগে। সবচেয়ে আগে। তারপরই মিলবে মনের মুক্তি। আর তারপর বাকিটা শুধু বিজয়ের গাঁথা- আর কোনদিন পিছনে ফিরে দেখতে হবে না তাকে। নারীবাদ নারীকে মুক্তি দেবে সহস্র বছরের নিপীড়ন আর বঞ্চনা থেকে- মুক্তির সেই ঘণ্টা বেজে গেছে। নারীবাদের কৌশল সে নিজেই ঠিক করে নেবে। কখন কী নিয়ে কথা বলতে হবে, নারীবাদীরা ঠিকমতই জানেন। কারণ নারীজীবনের যন্ত্রণা, বেদনা আর কষ্টের ভিতর দিয়েই তারা এই লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছেন। কোন এলিয়েন হয়ে এই পথে আসেননি। তাই
গলাবাজি করে এদেশে নারীবাদের এগিয়ে যাবার পথ আপনারা সামান্য কঠিন করে তুলবেন বড়জোর, কিন্তু বিজয় আর ছিনিয়ে আনতে পারবেন না। কারণ সত্যের মুক্তি অনিবার্য!
মজার মজার ভিডিও দেখতে নিচে লিংকের ক্লিপ করুণ https://www.youtube.com/channel/UCDUgcFp1WTEUfSzViR9tozA

Comments

Post a Comment

Thanks for you comment