ক্ষতিপূরণ মেলেনি দুই বছরেও দুই হাত হারানো চাকমা শিশুর দুঃসহ জীবন

দুই হাত হারানো শিশুর দুঃসহ জীবন
চঞ্চল চটপটে শিশুটি এখন প্রায়সময় আনমনা হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। কোনো কথা বলে না।
কিছু জানতে চাইলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মায়ের কাছে বলে, ‘মা আমার জীবনটা নাকি শেষ! তোমাদের অনেক কষ্ট দিচ্ছি। তবু তো বেঁচে আছি। কিন্তু তুমি যখন থাকবে না তখন আমার কী হবে? কীভাবে চলবে আমার জীবন। আমার জন্য দাদারও (বড়ভাই) মনে অনেক কষ্ট। ’
নাড়িকাটা সন্তানের কথাগুলো শুনে মায়ের বুকফাটা কান্না ছাড়া আর কিই বা করার থাকে। ঠিকাদারের গাফিলতিতে একটি দুর্ঘটনায় দিনমজুর বাদীচান চাকমার হাসিখুশি পরিবারে নেমে এসেছে দুঃখ। সবার কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে সারাক্ষণ। দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি সড়কের ১৪ কিলোমিটার এলাকায় তাঁর বাড়ি।
বাদীচান চাকমার সন্তান প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষার্থী অটল চাকমা।
একদিন বিদ্যালয়ে থেকে বাড়ি ফিরছিল। পথে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে ঝলসে যায় তার দুটি হাত। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর দুটি হাতই কাটতে হয়েছে শিশুটির। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। খাতা কলম ধরা হাত দুটি হারিয়ে গোসল, খাওয়াসহ কোনো কাজই করতে পারে না মায়ের সাহায্য ছাড়া। স্কুলের অন্য শিক্ষার্থীরা যখন বিদ্যালয়ে যায় তখন শুধু আনমনে তাকিয়ে থাকে সে। কচি বয়সেই সে যে শারীরিকভাবে নিজেই নিজের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা যেন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে সে। এতে আরো বেশি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে অটলের মন।
এদিকে ইতোমধ্যে বাবা-মা অটলের চিকিৎসায় কয়েক লাখ টাকা খরচ করে এখন পুরো নিঃস্ব। দুর্ঘটনার সময় চিকিৎসার জন্য সামান্য টাকা দিলেও পরে সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনো খোঁজ নেয়নি বলে অভিযোগ অটলের পরিবারের। অটলের ভবিষ্যত চিন্তা করে ক্ষতিপূরণ আদায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
বাদীচানের বাড়ির পাশেই বটতলা চায়ের দোকানে দেখা হয় ৭/৮ বছর বয়সি অটলের সাথে। ডান হাত পুরোই কাটা আর বাম হাত কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত কাটা। বাম হাতের কাটা অংশ দিয়েই একটি বোতল মুখের সাথে চেপে ধরে পান করছিল একজনের দেওয়া কোমল পানীয়। আর পাশে বসে মা ইতি চাকমা অটলের মুখে মুড়ি তুলে দিচ্ছিলেন। পাশে অটলের বড়ভাই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া দিগন্ত চাকমা। দিনমজুরি করতে যাওয়া বাবা বাদীচান চাকমা তখনো বাড়ি ফিরেননি।
ইতি চাকমা জানান, সেদিন ভাড়ায়চালিত একটি মোটরসাইকেল চালক অটলের হাতে ৫০টি টাকা দিয়ে বলেন,  ‘তোর তো জীবনটাই শেষ, ধর কিছু খাবি’। সেই থেকেই অটলের চিন্তা আরো বেড়ে গেছে। প্রায় সময় গুমরো মুখে থাকে। তিনি অটলকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। আবারও লেখাপড়ার ব্যবস্থা হবে বলেও সান্ত্বনা দেন। কিন্তু সে ব্যবস্থা যে আর জীবনে এ দরিদ্র পরিবারটির পক্ষে সম্ভব না! ইতোমধ্যে জায়গা-জমি বিক্রি করে অটলের চিকিৎসায় ৫-৬ লাখ টাকা খরচ করেছেন জানিয়ে ইতি চাকমা বলেন, ‘অটলের ভবিষ্যত জীবনের কথা ভেবে শেষ একটা চেষ্টা করব। আর তাই ক্ষতিপূরণ আদায়ে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছি। ’
অটলের একমাত্র বড়ভাই দিগন্ত চাকমা জানায়, অটল তার খুব আদরের ভাই। অটল পঙ্গু এ কথা মনে হলেই বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠে। এখন সবসময় ভাইটাকেই নিয়ে ভাবে সে। পড়ালেখায় নিজের মনও বসাতে পারে না দিগন্ত। সামান্য কোনো কিছু দোকান থেকে কিনলেও ভাইকে রেখে সে খায় না। আর মন চাইলেও পঙ্গু ভাইটিকে খাওয়ানোর জন্য ভালো কিছু কিনে আনতে পারে না টাকার অভাবে।
বটতলা চা দোকানদার শশাংক চাকমা বলেন, ‘শিশুবয়স থেকেই নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেত অটল। এখন সবসময় দোকানে বসে সময় পার করে। আর বিদ্যালয়গামী শিশুদের সাথে নানান বিষয়ে কথা বলে। তার পরিবারটিও এখন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় মানুষের সাহায্য আর ভালোবাসাই যেন অটলের সম্বল। মনে হয় এ জন্যই শিশুটি বেশি সময় দোকানে কাটায়। ’
অটলের বাবা বাদীচান চাকমা জানান, দিনমজুরি করে হলেও দুই সন্তান নিয়ে সুখেই কাটছিল সংসারজীবন। বিদ্যালয়পড়ুয়া দুই সন্তানই ছিল তাঁদের ভবিষ্যতের সুখের স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্ন এখন তছনছ হয়ে গেছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সামান্য ভুলে। অটলের চিকিৎসা খরচ মিটিয়ে এখন অনেকটা অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে পরিবারটির। অথচ সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে মানবিক কারণেও কোনো খোঁজ নেয়নি। করেনি কোনো আর্থিক সহযোগিতা।
বাঘাইছড়ি আবাসিক প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঘটনাটি ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবরের। দীঘিনালা থেকে বাঘাইছড়ি পর্যন্ত পার্বত্য বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের আওতাধীন বিদ্যুতের ৩৩ হাজার কেভির নতুন সঞ্চালন লাইনের কাজ চলছিল। ১৪ কিলোমিটার এলাকায় একটি খুঁটি ধরে রাখার জন্য তার দিয়ে টানা দেওয়া হয়। যে তারের অধিকাংশ ছিল মাটিতে। টানা দেওয়া সেই তার ছিঁড়ে গিয়ে পাশের ১১ হাজার কেভির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে লেগে যায়। আর শিশু শ্রেণির ছাত্র অটল ইউনেসেফ পরিচালিত আমতলী প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় (পাড়াকেন্দ্র) থেকে বাড়ি ফেরার সময় সেই তারে জড়িয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। অবশ্য ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম তখন সংবাদকর্মীদের নিকট স্বীকার করেন, শ্রমিকদের ভুলে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বাঘাইছড়ি আবাসিক প্রকৌশলী মো. আহসান উল্লাহ বলেন, ‘ঠিকাদারের কিছু গাফিলতি ছিল। যেভাবে তার দিয়ে খুঁটি আটকানো হয়েছিল, এতে আরো বড় ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। ’
Source মজার মজার ভিডিও দেখতে নিচে লিংকের ক্লিপ করুণ https://www.youtube.com/channel/UCDUgcFp1WTEUfSzViR9tozA

Comments