রাস্তা-ঘাটে মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের নামে তোলা ত্রাণ আসলে যাচ্ছে কোথায়?

তাদের উদ্দেশ্য খুবই মহৎ। অন্তত তাদের হাঁকডাকে তাই মনে হচ্ছিল। হিউম্যানিটি ফর রোহিঙ্গা’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সিলেট-টেকনাফ রোডমার্চ করে গিয়ে তারা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে চায়। তাই দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রীতিমত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে চলেছে প্রচারণা, উঠেছে কোটি টাকারও বেশি অনুদান। স্বয়ং কর্তৃপক্ষই জানিয়েছে যে দেশ-বিদেশ থেকে কোটি টাকারও বেশি অনুদান উঠেছে। কিন্তু সরকার নির্ধারিত পথে রোহিঙ্গাদের সাহায্য না করে কেন রোডমার্চের শো-অফ করে সাহায্য নিয়ে যেতে হবে সেই প্রশ্ন ওঠার মধ্যেই পাওয়া গেল ভয়ংকর এক প্রতারণা ও ভন্ডামির গল্প!
গত বৃহস্পতিবার নির্ধারিত স্থান সিলেটের হুমায়ূন রশীদ চত্বর থেকে ৬৮টি গাড়ির বহর নিয়ে শুরু হয় রোডমার্চ। কয়েক কিলোমিটারের মাথায় রশিদপুর যাওয়ার আগেই রোডমার্চ থামিয়ে দেয় পুলিশ। কারণ হিসেবে পুলিশ জানায়, রোডমার্চের কোন প্রশাসনিক অনুমতি নেয়া হয়নি। স্রেফ ত্রাণ বিতরণের জন্য নেয়া হয়েছে অনুমোদন। তো রোডমার্চের জন্য অনুমতি নেওয়া না হলে কোন যুক্তিতে রোডমার্চ নিয়ে ‘ত্রাণ বিতরণ’ করতে বের হলো কর্তৃপক্ষ? তাহলে যে রোডমার্চের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে হিউম্যানিটি ফর রোহিঙ্গা’র চেয়ারম্যান শাহিনূর পাশা চৌধুরী দাবী করেছিলেন যে প্রশাসন অনুমোদন দিয়েছে রোডমার্চের, দুইশো গাড়ি থাকবে বহরে, সব ডাহা মিথ্যে? এই প্রশ্নের ভেতরেই বেরিয়ে এল থলের বিড়াল।
পুলিশ পুরো বহর তল্লাশি করতে শুরু করলো, এত গাড়ি, এত মানুষ; কিন্তু ত্রাণ কই? খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে ৬৮টি গাড়ির মধ্যে ৬৭টিতেই শুধু মানুষ পাওয়া গেল, আর একটি গাড়ির পেছন দিকে পাওয়া গেলো অল্প কিছু ত্রাণের প্যাকেট। কত বড় জোচ্চুরি! কত বড় ধান্দাবাজি! পুলিশ সেই ত্রাণের গাড়িটি ছেড়ে দিল। আর বাকি ৬৭টি গাড়িভর্তি সকলকে ফিরিয়ে দিল।
এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র জেদান আল মুসা জানিয়েছেন, ত্রাণ বিতরণের কথা বলেই পুলিশের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছিলো। মানবিক কারণে সে অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবারের রোডমার্চের বহরে ত্রাণ ছিলো মাত্র কয়েক প্যাকেট। সঙ্গত কারণেই ত্রাণবাহী গাড়িটি ছাড়া বাকি গাড়িগুলো আটকে দেয়া হয়।
কিন্তু রোডমার্চের অনুমোদন না পেয়েও অনুমোদন পাওয়ার দাবী কেন করেছিলেন উদ্যোক্তারা? সেখানেও লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর প্রতারণার কৌশল। অনুমোদন না পাওয়ার খবর চাউর হলে সংগৃহীত বিশাল অংকের অনুদানের টাকা ফেরত চাইতে পারেন দাতারা। তাই যেভাবেই হোক একটি রোডমার্চের শো-ডাউন করে গোঁজামিল দিয়ে পুরো টাকাটা গায়েব করে ফেলা যাবে। সংবাদ সম্মেলনে শাহিনূর পাশা চৌধুরী দাবী করেছিলেন, দুই শতাধিক গাড়ি থাকবে রোডমার্চের বহরে। অথচ, মাত্র ৬৮টি গাড়ি নিয়েই শুরু হয় যাত্রা। দুইশ’ গাড়ির জন্য কোটি টাকার বাজেট হয়েছিলো। তাহলে গাড়ি ৬৮টি কেন? আর বহরে যোগ দেয়া গাড়িগুলোর মান দেখে যে কেউ বুঝতে পারবেন এ ধরনের লক্কড়-ঝক্কর গাড়ি নিয়ে সিলেট-টেকনাফ দুই হাজার কিলোমিটারের (যাওয়া-আসা) সফর সম্ভব নয়। এর মানে কি? মানে, উদ্যোক্তারা নিজেরাই জানতেন, রোডমার্চ সফল হবে না। তাদেরকে আটকে দেয়া হবে, যেহেতু অনুমোদন নেই। আরও মজার তথ্য হলো, রোডমার্চের জন্য যেসব গাড়ি রিজার্ভ করা হয়েছিলো সেগুলোকে টেকনাফ যাওয়ার জন্য রিজার্ভ করা হয়নি। কয়েক ঘণ্টার জন্য তাদের রিজার্ভ করা হয়েছিলো। উদ্যোক্তা সংগঠনের এক কর্মকর্তাই জানিয়েছেন এ তথ্য। তিনি জানান, প্রতিটি গাড়ি ৩৫০০ টাকা করে ভাড়া করা হয়। আর যেসব মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা রোডমার্চে যোগ দিয়েছিলেন তাদেরকে শেরপুর পর্যন্ত যাওয়ার কথা বলে আনা হয়েছে বলেও জানান এই নেতা।
অসহায় রোহিঙ্গাদের সাহায্যের নামে ধর্মের নামে ধান্ধাবাজিতে লাভটা কিন্তু একেবারে কম না!
ঠিক এইভাবেই সারাদেশে “রোহিঙ্গারা মুসলিম” “মুসলিম ভাইদের সাহায্য করুন” টাইপের ধর্মকে কেন্দ্র করে আবেগী কথাবার্তায় সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতিতে কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা তুলছে এক শ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ী বাটপারেরা। যেখানে রোহিঙ্গাদের মধ্যে মুসলিম ছাড়াও আছে হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষেরা, প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা করেছেন মুসলিম হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে, সেখানে এই অমানুষেরা রোহিঙ্গাদের মুসলিম পরিচয়কে উপস্থাপন করে সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে করছে চাঁদাবাজি, ভ্যানে মাইকিং করে, প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে সাহায্যের নামে ভরছে নিজেদের পকেট, গোছাচ্ছে নিজেদের আখের। আজকাল এই ত্রাণ আর সাহায্য তোলা পার্টির মাইকিং আর জনে জনে সাহয্যে চেয়ে হাঁকডাকে রাস্তায় বের হওয়া দায়, অথচ সাধারণ জনগনের কাছ থেকে এভাবে তাদের এই সাহায্য তোলা ক্ষেত্রবিশেষে হয়ে দাঁড়াচ্ছে চাঁদাবাজি! 
রোহিঙ্গা, ত্রাণ, মিয়ানমার, রোহিঙ্গা শরণার্থী, শরণার্থী,
“অত্র এলাকার তরুণ যুবসমাজ” নামে ব্যানার বানিয়ে তোলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্যে সাহায্য, এই যুবসমাজের সদস্য কারা? যে টাকা উঠছে সাহায্য হিসেবে, সেসবের হিসাব-নিকাশ কার কাছে? দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা কি আছেন এদের? সবচেয়ে বড় কথা, এই কাজের জন্যে কি তারা অনুমতি নিয়েছেন সরকার বা কোন সরকারী সংস্থার কাছে? যেভাবে চেয়ার টেবিল পেতে ব্যানার বানিয়ে হ্যান্ডমাইক হাতে নিয়ে টাকা তোলা হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইদের’ জন্যে, সেই টাকা শরণার্থীরা কিভাবে পাবেন? কতটা পাচ্ছেন? এসবের জবাবদিহিতা কে করবে? সহায়তা দেয়ার নামে এটা আবার কোন মৌসুমী ব্যবসা ফেঁদে বসা নয়তো?
যেখানে প্রথমদিন থেকেই সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ত্রাণ কার্যক্রম সুশৃঙ্খলতা আনতে এবং ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম ঠেকাতে, সব রোহিঙ্গার কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে ত্রাণ দিতে হবে সরকারী তহবিলে। কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ শুরু থেকেই সরকারী আদেশের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমত সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করে আবেগী বক্তব্য দিয়ে ত্রাণ তুলছে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাদের নেওয়া সাহায্য এবং ত্রাণ আদৌ অসহায় রোহিঙ্গাদের কাছে পৌছাচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
তার চেয়েও বড় এক প্রশ্ন থেকেই যায়। এই যে আজকে সারা দেশে রোহিঙ্গাদের মুসলিম পরিচয়কে সামনে রেখে সাহায্য তোলার জন্য এতো এতো মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে, বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদের পরিচয় স্রেফ “মুসলিম” হওয়ায় যারা আবেগী হয়ে যথাসাধ্য সাহায্য করছেন, ধরুন আজকে যদি রোহিঙ্গাদের সিংহভাগ মুসলিম না হয়ে হিন্দু হত বা বৌদ্ধ হত, কয়জন মানুষ রাস্তায় নামতেন? হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গাদের জন্যও কি মসজিদে মসজিদে, ভ্যানে মাইকিং করে, মাদ্রাসার ছাত্রদের কাজে লাগিয়ে সাহায্য তোলা হতো?
উত্তরটা আমাদের সবারই জানা। আজকে যে রোহিঙ্গাদের পরিচয় মুসলিম ভাই, তখন তাদের পরিচয় হত ভিনদেশী রোহিঙ্গা কাফের, বিধর্মী, মালাউন। তখন কিন্তু আজকের এই সাহায্য তোলা মানুষগুলোই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতো এইসব বিধর্মী কাফের রোহিঙ্গাদের এই দেশে আশ্রয় দেওয়ার জন্য।  এই সরকারকে বানিয়ে দিত মুসলিমবিদ্বেষী, বলতো যে এই দেশ থেকে ইসলাম ধ্বংসের চক্রান্ত হিসেবেই সরকার এইসব ভিনদেশী রোহিঙ্গা মালাউন কাফেরগুলাকে এই দেশে ঢুকিয়েছে। আফসোস, আমাদের মানবতা নির্ধারিত হয় ধর্মের ভিত্তিতে, নির্যাতন-ধর্ষণ ও হত্যার মুখোমুখি হয়ে যে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছে মিয়ানমার থেকে, মুসলিম বা হিন্দু হবার আগে তাদের পরিচয় মানুষ, তাদের মধ্যেও অনেকেই আছে হিন্দু, অথচ আমরা তাদের সাহায্য করছি তাদের বেশিরভাগ স্রেফ মুসলমান বলে। জাতি হিসেবে আমরা মানুষের আগে ধর্মকে স্থান দেই বলেই অসংখ্য ধান্দাবাজ বাটপার আমাদের সাথে প্রতিনিয়ত ধর্মের নামে প্রতারণা করে, তবুও আমরা সচেতন হই না, আমাদের বিবেকের দরজা খোলে না।
অথচ সরকার ও প্রশাসনের নির্ধারিত উপায়ে সাহায্যে পাঠালে কখনোই এ ধরণের প্রতারণার সুযোগ থাকতো না। যদি সত্যিই অসহায় রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে চাই, তাহলে আমাদের উচিত সব ধরণের ত্রাণ সহায়তা কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দেওয়া। আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান-সংগঠন জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার কর্তৃক খোলা নিম্নোক্ত হিসাব নম্বর-Account name : Humanitarian Assistance to the Myanmer Citizen Illegally Migrated (Rohingya).C/A no : 33024625.Sonali Bank Limited Cox’s Bazar BranchCox’s Bazar, Bangladesh. অথবা ত্রাণ সহায়তার জন্য : দুর্যোগ ও ত্রাণ শাখা, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, কক্সবাজার- এই ঠিকানায় ত্রাণ দিতে পারেন। আর  যেকোন তথ্যের জন্য ফোন নম্বর: ০৩৪১-৬৩২০০ ফ্যাক্স-অফিস: ০৩৪১-৬৩২৬৩ (অফিস) ই-মেইল: dccoxsbazar@mopa.gov.bd-তে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
চিন্তা নেই, ভয় পাবেন না। আপনার ত্রাণটা কোনভাবেই মার যাবে না, চুরি বা লুটপাট হবে না, কারণ এখন ত্রাণ সংগ্রহ এবং বিতরণের পুরো কার্যক্রম চালাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত সদস্যরা। সুতরাং অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠিয়ে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।
আসুন, মানবতার নামে সবধরণের প্রতারণা রুখে দেই, আমাদের পবিত্র ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে যেন কোন অধর্ম বা ব্যবসা হতে না পারে। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই!
Source http://egiye-cholo.com/relief-for-rohingya/
 মজার মজার ভিডিও দেখতে নিচে লিংকের ক্লিপ করুণ https://www.youtube.com/channel/UCDUgcFp1WTEUfSzViR9tozA

Comments